জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ৩৫ জনের একটি 'ক্রেজি টিম' আছে। বিশ্বজিৎ
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যারা জড়িত তারা এই দলেরই সদস্য। ভিডিও
ফুটেজ, ছবি ও বিভিন্ন সূত্র মতে, এই দলের অন্তত ১৯ জন বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে
জখম করার ঘটনায় জড়িত। বর্তমান ও সাবেক ৯ নেতার মদদে এই ক্রেজি টিম পুরান
ঢাকায় এখন বেপরোয়া।
এদিকে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১ জনকে আটক করার কথা স্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, তাঁরা অন্তত ১১ জনকে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে শনাক্ত হওয়া ১৪ জন গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। যেকোনো মূহূর্তে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে ১১ জনের তালিকা তৈরি করেছে।
৯ নেতার মদদে 'ক্রেজি' : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক ও বর্তমান ৯ জন নেতার মদদেই জগন্নাথের ছাত্রলীগকর্মীদের একটি অংশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অবরোধের দিন যারা হামলা চালিয়েছে, তারা এসব নেতার অনুসারী। বিভিন্ন অভিযোগে বহিষ্কৃত হলেও এসব ছাত্রলীগ ক্যাডারকে নিয়ে গ্রুপিং করছেন ওই সব ছাত্রলীগ নেতা। নেতাদের হাত ধরে রাজনীতিতে পা দিয়ে তারা এখন পদ লাভের চেষ্টা করছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের জগন্নাথ শাখার সাবেক সভাপতি কামারুল হাসান রিপনের গ্রুপে রাজনীতি করে জহির উদ্দিন বাবর। বাবরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রী লাঞ্ছনা, সাধারণ ছাত্রদের মারধর, ছাত্রদের জিম্মি করে চাঁদা আদায়, মোবাইল ফোন ছিনতাই, মাদক ও ইয়াবা সেবন এবং পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। বাবর বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির উপনাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক। বর্তমান কমিটির সভাপতি শরিফুল ইসলামের গ্রুপের সজীব, কালা সুমন, ইমদাদসহ কয়েকজন এবং সাধারণ সম্পাদক কিবরিয়া, শাকিল, সঞ্জীব, তাহসিনসহ কয়েকজন বাবরের নেতৃত্বেই চলে।
সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের মদদে আছে মিলন, জাহিদুল্লাহ মামুন ও আলামিন। সভাপতির গ্রুপে আছে মোশারফ, আজিজুল, সোহেল, সরলসহ কয়েকজন। কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক সাফায়াত উল্লাহ সাফায়েত নিয়ন্ত্রণ করেন রনি ও পিরোজপুরের প্রিন্সসহ কয়েকজনকে। সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আখন্দ গ্রুপে আছে রাজন, আগুনসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আরিফুল ইসলামের গ্রুপে আছে রফিকুল, আলাউদ্দিন, তরিকুলসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিনের গ্রুপে আছে নাহিদ, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রিন্সসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণের গ্রুপে সাইফুল, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও বিনয়সহ কয়েকজন। সূত্রে জানা যায়, কিবরিয়া কেন্দ্রীয় এক নেতার মদদপুষ্ট। সরকারের ঊর্ধ্বতন একটি মহলের ইন্ধনে চলছে মাগুরার ছেলে ইউনুস। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের এক তরুণ সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে চলে অভিযুক্ত নাহিদ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আরিফুল ইসলাম অভিযুক্তদের মদদ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন 'আমি দীর্ঘদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছি। আমি থাকা অবস্থায় এ ছেলেদের কয়েকবার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। সে সময় তারা দলে সক্রিয় হতে পারেনি।'
সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, 'আমরা এদের সুযোগ দিইনি। কিন্তু এখন কমিটিতে ঢোকার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। কেউ কেউ আবার তাদের মদদ দিচ্ছেন বলেও শুনতে পাই।'
পদ পেতেই বেপরোয়া : ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছে, জগন্নাথে সভাপতি ও সম্পাদকের কমিটি থাকলেও বিভিন্ন পদপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রীয় এবং সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখে। এ যোগাযোগের কারণে বহিষ্কৃত হয়েও দলে সক্রিয় রয়েছে তারা। একের পর এক অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
আরো জানা গেছে, আগামী ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করার কথা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকজনের সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিভি কেন্দ্রীয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও থানা পুলিশের কাছে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। কর্মীরা জানায়, নতুন কমিটিতে সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, দপ্তর, প্রচার, অর্থসহ বিভিন্ন সম্পাদক পদ পাওয়ার জন্য অভিযুক্ত কয়েকজন জোর লবিং চালাচ্ছিল। তাই তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বেশি ভূমিকা দেখাতে চাইছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা সবাই পদপ্রত্যাশী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম শাকিলের বড় ভাই শাহিন হাওলাদার তৎকালীন পটুয়াখালী পৌর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে শাহিন হাওলাদার পটুয়াখালী পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন। এসব প্রকাশের পরও ছাত্রলীগ নেতা বাবর শাকিলকে মদদ দেন। রক্ষা করেন বিভিন্ন অভিযোগ থেকে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ভোলার ছেলে মাহফুজুর রহমান নাহিদ ২০১১ সালের আহ্বায়ক কমিটিতে বরিশাল গ্রুপ হিসেবে খ্যাত যুগ্ম আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিনের গ্রুপে যোগ দেয়। এরপর বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা ঘটিয়ে নাহিদ আলোচনায় উঠে এলেও নিজাম তাকে রক্ষা করেন। তিনি বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সহসভাপতি পদপ্রার্থী।
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর এখন প্রকাশ পেয়েছে, নাহিদ ছাত্রলীগ করার আগে শিবিরের রাজনীতি করত। আবদুল কাদের তাহসিন ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পর সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের সঙ্গে যোগ দেয়। রিপনের ক্যাডার জহির উদ্দিন বাবরের সঙ্গে কাজ করত সে। তাহসিনের বড় ভাই তাফসীরুল কাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের একটি হলের সভাপতি ছিলেন। ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের গ্রুপে যোগ দেয় এবং ছাত্রলীগের ক্যাডার বাবরের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। বর্তমান কমিটির সভাপতি শরিফুল গ্রুপের রাজনীতি করে ইমদাদ। মীর নুরে আলম লিমন কামরুল হাসান রিপনের অনুসারী ও বাবরের সহকারী। চলতি বছরের ৩ অক্টোবর ছাত্রলীগ নতুন কমিটি দিলে সভাপতি শরিফুল ইসলামের গ্রুপে যোগ দেয়। সে নতুন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদ প্রত্যাশী ছিল। রাশেদুজ্জামান শাওন সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
ক্রেজি টিমে যারা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক সক্রিয় কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানায়, বিভিন্ন গ্রুপের কিছু বেপরোয়া কর্মী বিরোধী দলের কর্মসূচির সময় মিছিল-মিটিংয়ের সামনের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয়। তারাই বেপরোয়া হামলা চালায়। কয়েকজনের কাছে থাকে চাপাতি, ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় সাধারণ কর্মীরা এদের 'ক্রেজি' বলে অভিহিত করে। এই ক্রেজি ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে আছে মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ, রাজন তালুকদার, মীর নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, রফিকুল ইসলাম শাকিল, আজিজুল হক, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুছ আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, এইচ এম কিবরিয়া, প্রাণিবিদ্যার ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের সজীব ও সোহেল, সরল, আল আমিন উজ্জল, ছাহিদুল হক মানিক, রনি, আলাউদ্দিন, শিপলু ওরফে শেপু, শান্ত, শহিদুল, তরিকুল, রফিকুল, সাইফুল, সঞ্জীব বসাক, জাহিদুল্লাহ মামুন, জনি, আবু তাহের, সেলিম, টিপু, জাহিদ, রুদ্র, মোশারফ, সৌরভ ও নূরুদ্দিন সুমন ওরফে কালা সুমন।
জানা গেছে, ক্রেজি টিমের ৩৫ জনের মধ্যে ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও বিভিন্ন সূত্রের সহায়তায় বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় জড়িত অন্তত ১৯ জনকে শনাক্ত করা গেছে। তারা হলো মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ, রাজন তালুকদার, মীর নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, রফিকুল ইসলাম শাকিল, আজিজুল হক, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুছ আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, এইচ এম কিবরিয়া, প্রাণিবিদ্যার ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের সজীব ও সোহেল, শিপলু, আল আমিন উজ্জল, আলাউদ্দিন, সাইফুল, হিসাববিজ্ঞানের মোশারফ ও কালা সুমন। গ্রুপের রফিকুল ইসলাম শাকিল, রাজন তালুকদার ও লিমন সব সময় সঙ্গে চাপাতি বহন করে। ঘটনার দিন ভিক্টোরিয়া ডেন্টাল ক্লিনিকের দোতলায় রাজনই প্রথম বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। পরে শাকিল, নাহিদ, ইউনুস, তাহসিনসহ অন্যরা হামলা চালায়।
আরো জানা গেছে, সেদিন ক্রেজি গ্রুপের কিছু সদস্য নিচে অপেক্ষা করছিল। বিশ্বজিৎ জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে নেমে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা হামলা চালায়। আরো জানা গেছে, মিছিল থেকে কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী বিশ্বজিতের ওপর হামলায় অংশ নেয়। তবে ছবি স্পষ্ট না থাকায় তাদেরকে কেউই শনাক্ত করতে পারছে না। তবে জানা গেছে, ওই হামলার মিছিলে কবি নজরুল কলেজের কালা পারভেজ, হোসেন ও সায়মন উপস্থিত ছিল।
গোয়েন্দা তালিকায় ১১ জন : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ১০ জনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলো রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, সাইফুল ইসলাম, রাজন তালুকদার, আজিজুল হক, আল আমিন, রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুস আলী ও শিপলু।
ছাত্রলীগের বক্তব্য : অভিযোগ ও সার্বিক ঘটনা প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ছাত্রলীগের বহিরাগত সাবেক নেতাদের মদদে কিছু বহিষ্কৃত কর্মী হত্যা করেছে বিশ্বজিৎকে। আমি এ ঘটনা কিছুই জানতাম না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের সময়ও আমি কিছু শুনিনি।' শরিফুল স্বীকার করেন, ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে কয়েকজন বেপরোয়া হয়ে হামলা চালায়। তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না দাবি করে তিনি বলেন, তারা ছাত্রলীগের কোনো পদে নেই। তবে ভবিষ্যতে যেন তারা পদে না আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কমিটি ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি।
এদিকে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১ জনকে আটক করার কথা স্বীকার করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, তাঁরা অন্তত ১১ জনকে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে শনাক্ত হওয়া ১৪ জন গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে। যেকোনো মূহূর্তে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এদিকে তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে ১১ জনের তালিকা তৈরি করেছে।
৯ নেতার মদদে 'ক্রেজি' : অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাবেক ও বর্তমান ৯ জন নেতার মদদেই জগন্নাথের ছাত্রলীগকর্মীদের একটি অংশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অবরোধের দিন যারা হামলা চালিয়েছে, তারা এসব নেতার অনুসারী। বিভিন্ন অভিযোগে বহিষ্কৃত হলেও এসব ছাত্রলীগ ক্যাডারকে নিয়ে গ্রুপিং করছেন ওই সব ছাত্রলীগ নেতা। নেতাদের হাত ধরে রাজনীতিতে পা দিয়ে তারা এখন পদ লাভের চেষ্টা করছে।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের জগন্নাথ শাখার সাবেক সভাপতি কামারুল হাসান রিপনের গ্রুপে রাজনীতি করে জহির উদ্দিন বাবর। বাবরের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, শিক্ষক, সাংবাদিক ও ছাত্রী লাঞ্ছনা, সাধারণ ছাত্রদের মারধর, ছাত্রদের জিম্মি করে চাঁদা আদায়, মোবাইল ফোন ছিনতাই, মাদক ও ইয়াবা সেবন এবং পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। বাবর বর্তমানে কেন্দ্রীয় কমিটির উপনাট্য ও বিতর্কবিষয়ক সম্পাদক। বর্তমান কমিটির সভাপতি শরিফুল ইসলামের গ্রুপের সজীব, কালা সুমন, ইমদাদসহ কয়েকজন এবং সাধারণ সম্পাদক কিবরিয়া, শাকিল, সঞ্জীব, তাহসিনসহ কয়েকজন বাবরের নেতৃত্বেই চলে।
সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমান কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলামের মদদে আছে মিলন, জাহিদুল্লাহ মামুন ও আলামিন। সভাপতির গ্রুপে আছে মোশারফ, আজিজুল, সোহেল, সরলসহ কয়েকজন। কেন্দ্রীয় কমিটির সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক সাফায়াত উল্লাহ সাফায়েত নিয়ন্ত্রণ করেন রনি ও পিরোজপুরের প্রিন্সসহ কয়েকজনকে। সাবেক আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম আখন্দ গ্রুপে আছে রাজন, আগুনসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আরিফুল ইসলামের গ্রুপে আছে রফিকুল, আলাউদ্দিন, তরিকুলসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিনের গ্রুপে আছে নাহিদ, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রিন্সসহ কয়েকজন। সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণের গ্রুপে সাইফুল, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন ও বিনয়সহ কয়েকজন। সূত্রে জানা যায়, কিবরিয়া কেন্দ্রীয় এক নেতার মদদপুষ্ট। সরকারের ঊর্ধ্বতন একটি মহলের ইন্ধনে চলছে মাগুরার ছেলে ইউনুস। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের এক তরুণ সংসদ সদস্যের নাম ভাঙিয়ে চলে অভিযুক্ত নাহিদ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আরিফুল ইসলাম অভিযুক্তদের মদদ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন 'আমি দীর্ঘদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করেছি। আমি থাকা অবস্থায় এ ছেলেদের কয়েকবার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। সে সময় তারা দলে সক্রিয় হতে পারেনি।'
সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, 'আমরা এদের সুযোগ দিইনি। কিন্তু এখন কমিটিতে ঢোকার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। কেউ কেউ আবার তাদের মদদ দিচ্ছেন বলেও শুনতে পাই।'
পদ পেতেই বেপরোয়া : ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী জানিয়েছে, জগন্নাথে সভাপতি ও সম্পাদকের কমিটি থাকলেও বিভিন্ন পদপ্রত্যাশীরা কেন্দ্রীয় এবং সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ রাখে। এ যোগাযোগের কারণে বহিষ্কৃত হয়েও দলে সক্রিয় রয়েছে তারা। একের পর এক অপকর্ম করেও পার পেয়ে যাচ্ছে তারা।
আরো জানা গেছে, আগামী ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করার কথা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কয়েকজনের সিভি (জীবনবৃত্তান্ত) গ্রহণ করা হয়েছে। এসব সিভি কেন্দ্রীয় কমিটি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও থানা পুলিশের কাছে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে। কর্মীরা জানায়, নতুন কমিটিতে সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, দপ্তর, প্রচার, অর্থসহ বিভিন্ন সম্পাদক পদ পাওয়ার জন্য অভিযুক্ত কয়েকজন জোর লবিং চালাচ্ছিল। তাই তারা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বেশি ভূমিকা দেখাতে চাইছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা সবাই পদপ্রত্যাশী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রফিকুল ইসলাম শাকিলের বড় ভাই শাহিন হাওলাদার তৎকালীন পটুয়াখালী পৌর ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে শাহিন হাওলাদার পটুয়াখালী পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে রয়েছেন। এসব প্রকাশের পরও ছাত্রলীগ নেতা বাবর শাকিলকে মদদ দেন। রক্ষা করেন বিভিন্ন অভিযোগ থেকে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ভোলার ছেলে মাহফুজুর রহমান নাহিদ ২০১১ সালের আহ্বায়ক কমিটিতে বরিশাল গ্রুপ হিসেবে খ্যাত যুগ্ম আহ্বায়ক নিজাম উদ্দিনের গ্রুপে যোগ দেয়। এরপর বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা ঘটিয়ে নাহিদ আলোচনায় উঠে এলেও নিজাম তাকে রক্ষা করেন। তিনি বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সহসভাপতি পদপ্রার্থী।
বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর এখন প্রকাশ পেয়েছে, নাহিদ ছাত্রলীগ করার আগে শিবিরের রাজনীতি করত। আবদুল কাদের তাহসিন ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষের মনোবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির পর সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের সঙ্গে যোগ দেয়। রিপনের ক্যাডার জহির উদ্দিন বাবরের সঙ্গে কাজ করত সে। তাহসিনের বড় ভাই তাফসীরুল কাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের একটি হলের সভাপতি ছিলেন। ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ সাবেক সভাপতি কামরুল হাসান রিপনের গ্রুপে যোগ দেয় এবং ছাত্রলীগের ক্যাডার বাবরের সঙ্গে মিলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। বর্তমান কমিটির সভাপতি শরিফুল গ্রুপের রাজনীতি করে ইমদাদ। মীর নুরে আলম লিমন কামরুল হাসান রিপনের অনুসারী ও বাবরের সহকারী। চলতি বছরের ৩ অক্টোবর ছাত্রলীগ নতুন কমিটি দিলে সভাপতি শরিফুল ইসলামের গ্রুপে যোগ দেয়। সে নতুন কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদ প্রত্যাশী ছিল। রাশেদুজ্জামান শাওন সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম শ্রাবণের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে।
ক্রেজি টিমে যারা : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক সক্রিয় কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানায়, বিভিন্ন গ্রুপের কিছু বেপরোয়া কর্মী বিরোধী দলের কর্মসূচির সময় মিছিল-মিটিংয়ের সামনের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেয়। তারাই বেপরোয়া হামলা চালায়। কয়েকজনের কাছে থাকে চাপাতি, ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় সাধারণ কর্মীরা এদের 'ক্রেজি' বলে অভিহিত করে। এই ক্রেজি ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে আছে মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ, রাজন তালুকদার, মীর নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, রফিকুল ইসলাম শাকিল, আজিজুল হক, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুছ আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, এইচ এম কিবরিয়া, প্রাণিবিদ্যার ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের সজীব ও সোহেল, সরল, আল আমিন উজ্জল, ছাহিদুল হক মানিক, রনি, আলাউদ্দিন, শিপলু ওরফে শেপু, শান্ত, শহিদুল, তরিকুল, রফিকুল, সাইফুল, সঞ্জীব বসাক, জাহিদুল্লাহ মামুন, জনি, আবু তাহের, সেলিম, টিপু, জাহিদ, রুদ্র, মোশারফ, সৌরভ ও নূরুদ্দিন সুমন ওরফে কালা সুমন।
জানা গেছে, ক্রেজি টিমের ৩৫ জনের মধ্যে ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও বিভিন্ন সূত্রের সহায়তায় বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনায় জড়িত অন্তত ১৯ জনকে শনাক্ত করা গেছে। তারা হলো মাহফুজুর রহমান নাহিদ, ইমদাদুল হক ওরফে কাইল্যা ইমদাদ, রাজন তালুকদার, মীর নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, রফিকুল ইসলাম শাকিল, আজিজুল হক, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুছ আলী, আবদুল্লাহ আল মামুন, এইচ এম কিবরিয়া, প্রাণিবিদ্যার ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষের সজীব ও সোহেল, শিপলু, আল আমিন উজ্জল, আলাউদ্দিন, সাইফুল, হিসাববিজ্ঞানের মোশারফ ও কালা সুমন। গ্রুপের রফিকুল ইসলাম শাকিল, রাজন তালুকদার ও লিমন সব সময় সঙ্গে চাপাতি বহন করে। ঘটনার দিন ভিক্টোরিয়া ডেন্টাল ক্লিনিকের দোতলায় রাজনই প্রথম বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। পরে শাকিল, নাহিদ, ইউনুস, তাহসিনসহ অন্যরা হামলা চালায়।
আরো জানা গেছে, সেদিন ক্রেজি গ্রুপের কিছু সদস্য নিচে অপেক্ষা করছিল। বিশ্বজিৎ জীবন বাঁচাতে ভবন থেকে নেমে পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা হামলা চালায়। আরো জানা গেছে, মিছিল থেকে কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী বিশ্বজিতের ওপর হামলায় অংশ নেয়। তবে ছবি স্পষ্ট না থাকায় তাদেরকে কেউই শনাক্ত করতে পারছে না। তবে জানা গেছে, ওই হামলার মিছিলে কবি নজরুল কলেজের কালা পারভেজ, হোসেন ও সায়মন উপস্থিত ছিল।
গোয়েন্দা তালিকায় ১১ জন : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে ১০ জনের নাম উঠে এসেছে। তারা হলো রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, নুরে আলম লিমন, আবদুল কাদের তাহসিন, সাইফুল ইসলাম, রাজন তালুকদার, আজিজুল হক, আল আমিন, রাশেদুজ্জামান শাওন, ইউনুস আলী ও শিপলু।
ছাত্রলীগের বক্তব্য : অভিযোগ ও সার্বিক ঘটনা প্রসঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ছাত্রলীগের বহিরাগত সাবেক নেতাদের মদদে কিছু বহিষ্কৃত কর্মী হত্যা করেছে বিশ্বজিৎকে। আমি এ ঘটনা কিছুই জানতাম না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানের সময়ও আমি কিছু শুনিনি।' শরিফুল স্বীকার করেন, ছাত্রলীগকর্মীদের মধ্যে কয়েকজন বেপরোয়া হয়ে হামলা চালায়। তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না দাবি করে তিনি বলেন, তারা ছাত্রলীগের কোনো পদে নেই। তবে ভবিষ্যতে যেন তারা পদে না আসতে পারে সেই ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি জানান, কেন্দ্রীয় কমিটি ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক শেখ রাসেল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ ঘটনায় কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি।