দেশের সর্বাধিনায়ক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস এবং সাধারণ জনগণের রায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াসের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতা পিতারা এই পদ্ধতিকে সংবিধানে অঙ্গীভূত করেছিলেন আজ থেকে প্রায় দু’শ বছর আগে।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজনকে বেছে নেওয়ার জন্য ‘ইলেক্টর’ বা নির্বাচক মনোনয়নের একটি প্রক্রিয়া। ইলেক্টর নামে অভিহিত এই মনোনীত নির্বাচকরাই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে থাকেন। আর সমগ্র প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মার্কিন আইন পরিষদ কংগ্রেসে।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রে মোট নির্বাচক বা ইলেক্টরের সংখ্যা ৫৩৮ জন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট নিশ্চিত করতে হবে।
কংগ্রেসে কোনো রাজ্যের তরফে থাকা প্রতিনিধির অনুপাতে নির্ধারিত হয় ওই রাজ্যের মোট ইলেক্টরের সংখ্যা। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ বা হাউস অব রিপ্রেসেন্টিটিভে কোনো রাজ্যের প্রেরিত প্রত্যেক প্রতিনিধির বিপরীতে একজন করে ইলেক্টর মনোনীত হন। এছাড়া প্রত্যেক সিনেট সদস্যের বিপরীতেও একজন করে ইলেক্টর মনোনীত হয়ে থাকেন। অবশ্য মার্কিন সিনেটে প্রত্যেক রাজ্যের জন্য দুটি সিনেট সদস্য পদ সংরক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রে জনসংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায় নেওয়া হয়না।
তবে মার্কিন সংবিধানের ২৩ তম সংশোধনী অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য ছাড়াও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার জন্য ৩ জন অতিরিক্ত ইলেক্টর বা নির্বাচকের সুযোগ রাখা হয়েছে। ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতির স্বার্থে এজন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়াকেও একটি রাজ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রত্যেক প্রার্থী নিজের অথবা তার দলের পছন্দ অনুযায়ী ইলেক্টরের মনোনয়ন দিতে পারবেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলোই মূলত ইলেক্টরে মনোনয়ন দিয়ে থাকে।
তবে একজন ব্যক্তির ইলেক্টর হিসেবে মনোনয়ন লাভের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সম্পর্কে প্রত্যেক রাজ্যেরই নিজস্ব কিছু অবশ্য পালনীয় বিধি বিধান আছে।
প্রথা অনুযায়ী প্রতি চারবছর শেষে নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরবর্তী মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন।
একজন ভোটার নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্টের জন্য ভোট দেওয়ার সময় একই সঙ্গে ইলেক্টোরাল প্রতিনিধির জন্যও ভোট দেন। আসলে ভোটাররা ইলেক্টর নির্বাচনের জন্যই ভোট দেন, কারণ কাগজে কলমে এই ইলেক্টরদের ভোটেই নির্বাচিত হন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট।
বেশিরভাগ রাজ্যেই অবশ্য ‘বিজয়ীই সব পাবে’ এই নীতিতে ওই রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট বণ্টিত হয়। অর্থাৎ একটি রাজ্যে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দলই ওই রাজ্যের জন্য বরাদ্দ করা সব ইলেক্টোরাল ভোট আপনাআপনি লাভ করবে। তবে মেইন ও নেব্রাস্কা রাজ্যে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। সেখানে রাজ্যের জন্য বরাদ্দকৃত ইলোক্টারাল ভোট ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ পদ্ধতি অনুযায়ী ভাগ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রাজ্যে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল পায় দুটি ইলেক্টর ভোট আবার প্রত্যেক কংগ্রেসনাল ডিস্ট্রিক্টে বিজয়ী রাজনৈতিক দল পায় একটি করে ইলেক্টর ভোট।
প্রেসিডেন্সিয়াল ভোট শেষ হওয়ার পর প্রত্যেক রাজ্যের গভর্নর একটি করে ‘সার্টিফিকেট অব অ্যাসারটেইনমেন্ট’ বা নির্বাচক নির্ধারণের সনদ প্রস্তুত করেন। এতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নাম এবং তাদের প্রতিনিধি ইলেক্টরদের নামের তালিকাও থাকে। এছাড়া থাকে ওই রাজ্যে প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের তালিকাও।
এই সনদ কংগ্রেস এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাফেজখানা ‘ন্যাশনাল আরকাইভসে’ প্রেরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক রেকর্ড রাখাই এ ব্যবস্থার উদ্দেশ্য।
নির্বাচনের ভোটগ্রহণের শেষে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় বুধবার পরবর্তী প্রথম সোমবার অনুষ্ঠিত হয় ইলেক্টরদের বৈঠক। নিজ নিজ রাজ্যে বৈঠকে মিলিত হয়ে ইলেক্টররা নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে আলাদা আলাদা ব্যালটে ভোট দেন।
রাজ্যের ইলেক্টরদের ভোট ‘সার্টিফিকেট অব ভোট’ হিসেবে পরিগণিত ও তালিকাবদ্ধ হয়। প্রত্যেক রাজ্যের ‘সার্টিফিকেট অব ভোট’ পরবর্তীতে কংগ্রেসে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আরকাইভ বা জাতীয় মহাফেজখানায় পাঠানো হয়।
জানুয়ারির ছয় তারিখে কংগ্রেসের একটি যৌথ অধিবেশনে এই ইলেক্টোরাল ভোট গণনা করা হয়। মার্কিন কংগ্রেসনাল হাউজ এবং সিনেটের সদস্যরা হাউজ চেম্বারে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হয়ে ইলোক্টারাল ভোটের ফলাফলের একটি আনুষ্ঠানিক তালিকা প্রনয়ণ করেন।
সিনেটের সভাপতি ভোট গণনা অনুষ্ঠান তদারকি করে এবং ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন। এর পর সিনেটের সভাপতি চূড়ান্তভাবে নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করেন। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জানুয়ারির ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘অফিস অব দি ফেডারেল রেজিস্টার’ মূলত এই ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি তদারক করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভস বা জাতীয় মহাফেজখানা, রাজ্য কর্র্তৃপক্ষ, কংগ্রেস এবং দেশের সাধারণ জনগণের পক্ষে তারা এ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করে থাকে।