0 সরেজমিনহামলাকারীদের অতীত কীর্তি

বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযুক্ত শাকিলের বাবা আনছার আলী লজ্জায়, গ্লানিতে মুখ দেখাতে পারছেন না। এখন ছেলের শাস্তি হলেই শান্তি পাবেন বাবা আনছার আলী। একইভাবে সন্তানের শাস্তি চান ইমদাদের মা জোহরা বেগম। 'ইমদাদ যে মায়ের বুক খালি কইরেছে, তার জন্যি কষ্ট হচ্ছে,' কালের কণ্ঠকে বলেন জোহরা। মাদ্রাসাশিক্ষক উচ্চশিক্ষার জন্য ছেলে মাহফুজুর রহমান নাহিদকে পাঠিয়েছিলেন ঢাকায়। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে ছেলের অংশ নেওয়ার খবরে রীতিমতো শয্যাশায়ী নাহিদের বাবা। এদিকে অভিযুক্ত ইমদাদুল হকের স্বভাব-চরিত্র যে আগে থেকেই ভালো ছিল না, কলেজজীবনে লজিং থাকার সময়ই সে গৃহকর্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছিল, তা জানা যায় তার স্বজন ও এলাকাবাসীর কাছ থেকে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর গ্রামের বাড়ি গিয়ে এসব তথ্য তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সেসব তথ্য জানিয়েছেন কালের কণ্ঠের স্থানীয় প্রতিনিধিরা।
শাকিল : 'ওই রাতে ওর হাতে অস্ত্র, মাদক আর বেপরোয়া চলাফেরা দেখে আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। পরে আর যোগাযোগই রাখিনি', বলছিলেন অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম শাকিলের ছোটবেলার বন্ধু মনিরুল ইসলাম মনির। তিনি জানান, শাকিলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তাঁর যোগাযোগ হতো। ২০১০ সালের মাঝামাঝি ঢাকায় এক রাতে তিনি শাকিলের সঙ্গে ছিলেন। ওই রাতে শাকিল ৮-১০ জন বন্ধু নিয়ে মাদক সেবন করে। বন্ধুদের সবাই ছিল ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এবং তাদের মধ্যে ছয়জন ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তবে চাপাচাপির পরও মনির কোনো মাদক সেবন করেননি। মনির জানান, শাকিল পটুয়াখালী সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণী পাসের পর চলে যায় ঢাকা। সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে ভর্তি হয়।
পটুয়াখালী ফায়ার সার্ভিস রোড এলাকায় শাকিলদের বাড়ি। বাবা আনছার আলী এমএলএসএস পদে কর্মরত ছিলেন পটুয়াখালী আয়কর অফিসে। ২০০৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন। গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাখেরগঞ্জ উপজেলার মহেশপুরা গ্রামে। তাঁর দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী শাহিদা বেগমকে নিয়ে পটুয়াখালী থাকেন। শাকিলের বড় ভাই শাহিন পটুয়াখালী পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাকিলের বাবা আনছার আলী বলেন, 'আমি ওকে (শাকিল) লেখাপড়া করার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি, সন্ত্রাসী বা মাস্তানি করতে না। ওর কর্মকাণ্ড টেলিভিশনের পর্দায় দেখে সমাজে এখন আর মুখ দেখাতে পারছি না। আমি চাই ওর উপযুক্ত শাস্তি হোক। এ সন্তান থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।'
মাহফুজুর রহমান নাহিদ : বাড়ি ভোলার দৌলতখান উপজেলার দক্ষিণ জয়নগর গ্রামে। বাবা মাওলানা আবদুর রহমান স্থানীয় দক্ষিণ জয়নগর হোছাইনিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাহফুজ ২০০১ সালে দাখিল এবং ২০০৩ সালে আলিম পাস করার পর ঢাকায় চলে যায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিষয়ে অনার্স শেষে বর্তমানে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। গত জুলাই মাসে বরিশালে পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদে পরীক্ষা দেয় মাহফুজ।
গ্রামের বিভিন্ন সূত্রমতে, আলিমে পড়া অবস্থায়ই সহপাঠীদের সঙ্গে স্থানীয় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় মাহফুজ। কিন্তু বাবা ও বড় ভাইয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে সক্রিয় রাজনীতি করা হয়নি তার। ঢাকায় যাওয়ার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় সে।
মাহফুজের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, তার বৃদ্ধ বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাওলানা আবদুর রহমান এ ঘটনা শোনার পর থেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। স্বজন-প্রতিবেশী কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না। একই অবস্থা মাহফুজের মা সামসুন নাহারের।
স্বজনরা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসাশিক্ষক বাবা তাঁর ছেলেকে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক বানাতে উচ্চশিক্ষার জন্য রাজধানী ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। আর সেই ছেলে অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে মানুষ হত্যা করছে- এমন দৃশ্য দেখার পর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বাবা মাওলানা আবদুর রহমান। মা সামসুন নাহার ছেলের জন্য বিলাপ করতে করতে এখন নির্বাক। এ ঘটনায় হতবাক মাহফুজের সহপাঠী, প্রতিবেশী, স্বজন সবাই।
বড় ভাই মাকসুদুর রহমান জানান, মাহফুজের এই কর্মকাণ্ড দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে তাঁদের পরিবার। ছেলের (মাহফুজের) এমন কাজে স্থবির হয়ে গেছে পুরো পরিবার। কী কারণে মাহফুজ এমন নৃশংস কর্মকাণ্ডে জড়িত হলো, তা জানা নেই পরিবারের কারোই।
ইমদাদুল হক : যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচকায়বা গ্রামের গরিব কৃষক আকরাম আলীর সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে ষষ্ঠ ইমদাদুল। মাঝবয়সী মা জোহরা বেগম সন্তানের নৃশংসতার কথা প্রতিবেশীর কাছে শুনেছেন। গতকাল যশোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে ইমদাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার মা জোহরা মলিন একটি শাড়ি পরে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তিনি বলেন, 'ইমদাদ যে মায়ের বুক খালি কইরেছে, তার জন্যি কষ্ট হচ্ছে। কোন শয়তান ওর ওপর ভর করিছিল, তা আল্লায় জানে। ছাওয়ালডা ঢাকায় যাইয়ে সঙ্গদোষে খারাপ হইয়েছে।' জোহরা আরো বলেন, 'তোমরা যা ভালো মনে করো, তাই করো। ছেলের শাস্তি দিলে দাও।'
ইমদাদের বাবা তিন বছর আগে মারা গেছেন। ইমদাদের ভাই জাকির জানান, 'সে ঢাকায় ছাত্রলীগ করত এবং কোনো একটি হলের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল বলে আমাদের বলেছে।'
ইমদাদের ভগ্নিপতি নরিম আলী বলেন, কলারোয়া উপজেলার কাজীরহাট কলেজে লেখাপড়া করার সময় এলাকার এক গ্রামে লজিং থাকত ইমদাদ। সে একদিন গৃহকর্তার স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে সালিসে মীমাংসা হয়।
বাইকোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, 'ইমদাদ আমাদের স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। ও নম্র-ভদ্র ছিল। কোনো অভিযোগ শুনিনি তারা বিরুদ্ধে।' এলাকার ইউপি সদস্য নিজামুদ্দিন বলেন, 'ইমদাদ বাড়িতে খুব কম আসত। গ্রামে তার নামে কোনো অভিযোগ শুনিনি।' শার্শা থানার ডিউটি অফিসার এএসআই সোমেন কুমার বিশ্বাস বলেন, 'ইমদাদকে ধরার জন্য তার গ্রামের বাড়িসহ সম্ভাব্য সব স্থানে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তার নামে থানায় কোনো অভিযোগ আছে কি না, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।'
ওবায়দুল কাদের তাহসীন : বাড়ি নোয়াখালী জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার পৌর এলাকার চরকৈলাশ গ্রামে। পরিবার জামায়াত-শিবিরের সমর্থক। বাবা মাওলানা মো. মহিউদ্দিন স্থানীয় আজহার উলুম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। তিনি একসময় ছাত্রশিবির হাতিয়া উপজেলার সভাপতি ছিলেন। তাঁর দাদা মরহুম মাওলানা রুহুল আমিন হাতিয়া উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ছিলেন। তাহসীনের বড় ভাই সাব্বির আহাম্মেদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্রশিবিরের সভাপতি এবং সে ফারুক হত্যা মামলার ২ নাম্বার আসামি।
ছোট ভাই মঞ্জুরুল কাদের আজহার উলুম মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার্থী। দুই বোনের মধ্যে বড় বোন তাহমিনা আক্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সম্মানের ছাত্রী। ছোট বোন তাহমিদা আক্তার (১০) মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে।
গতকাল তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা ফরিদা খানম, ছোট ভাই মঞ্জুর কাদের ও ছোট বোন তাহমিদা বাড়িতে রয়েছে। মঞ্জুর জানায়, তার বড় ভাই সাব্বির শিবিরের সঙ্গে জড়িত, এটা সে জানে। মেজ ভাই তাহসীন জগন্নাথে কোনো দল করে কি না, তা সে জানে না। তাহসিন ২০০৩ সালে হাতিয়ার এএম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করার পর ঢাকার কুর্মিটোলা শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। এরপর ভর্তি হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হাতিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জানান, তাহসীন স্কুলজীবনে এখানে পড়ালেখা করলেও ছাত্রলীগের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ ছিল না। হাতিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মো. ইদ্রিস জানান, তাহসীনের বাবা মাওলানা মহিউদ্দিন তাঁদের দলের কোনো সক্রিয় কর্মী নন, সমর্থক। হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোক্তার আহাম্মেদ জানান, তাহসীনের পুরো পরিবারই জামায়াত শিবির করত। তার বড় ভাই সাব্বির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের নেতা এবং ফারুক হত্যা মামলার ২ নম্বর আসামি। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর তাহসীনের বাবাকে দেখা যাচ্ছে না।
নূরে আলম লিমন : রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পূর্ব শুলি্লপাড়া গ্রামে বাড়ি। বাবা মীর মো. নূরুল ইসলাম ১২-১৩ বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে স্ত্রী নুর বানু ও ছেলে লিমনকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। এর পর থেকে দরিদ্র এ পরিবারটির গ্রামের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। গ্রামের বাসিন্দা সফর আলী বলেন, 'ঢাকায় যাওয়ার পর নূরুল ইসলামের ছেলে এমন হয়েছে, সেটা জানা ছিল না। এ ঘটনায় তার শাস্তি হওয়া উচিত।' লিমনের চাচাতো ভাই আফছার আলী মীর জানান, গ্রামে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ঢাকায় যাওয়ার পর এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় লিমন।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates