0 জাবির সংঘর্ষের নেতৃত্বে সেই ভিসিলীগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ও শিক্ষকদের অপরাজনীতির কারণে বারবার এমন সংঘর্ষ হচ্ছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা ক্যাম্পাসে একের পর এক অরাজকতা সৃষ্টি করছে। এদিকে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম, পুলিশের ওপর হামলা ও বিক্ষোভ চলাকালে গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ২০০ জনের বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে।
জানা গেছে, গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে জখম করা, বৃহস্পতিবার ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধের সময় আশুলিয়া থানা পুলিশে ওপর হামলা ও বিক্ষোভ
চলাকালে গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় পৃথক তিনটি মামলা হয়েছে। ছাত্রলীগের একাংশের নেতা তাহমিদুল ইসলাম লিখনকে হত্যার উদ্দেশে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় তার মা কাজী জোহরা বেগম ৯ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ২৫ জনকে আসামি করে সাভার থানায় মামলা করেছেন। অন্যদিকে পুলিশে ওপর হামলা ঘটনায় আশুলিয়া থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে ও বিক্ষোভ চলাকালে গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ১৭৫ জনকে আসামি করে সাভার থানায় মামলা করেছেন এসআই সাজ্জাদ রোমন ও বদরুল আলম। তবে পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। আশুলিয়া থানার ওসি মোস্তফা কামাল জানান, বিশ্ববিদ্যালয় দায়িত্ব পালনরত দারোগা বিল্লাল হোসেনকে জখম করাসহ পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের নেতা তাহমিদুল ইসলাম লিখনকে বুধবার রাতে কুপিয়ে আহত করে ক্যাম্পাসের অবস্থানরত সেই ভিসিলীগের নেতা রিয়াজ মাহমুদ (সরকার ও রাজনীতি বিভাগ ৩৬তম ব্যাচ), সাদেকুল ইসলাম নাহিদ (নৃবিজ্ঞান বিভাগ ৩৯তম ব্যাচ) আবদুল কাইয়ুম বিপুল (ইংরেজি বিভাগ ৩৮তম ব্যাচ), আশরাফুজ্জামান লিটন (অর্থনীতি বিভাগ ৩৫তম ব্যাচ), তীলন (লোক প্রশাসন বিভাগ ৩৭তম ব্যাচ) ও বুলবুলসহ (দর্শন বিভাগ ৩৭তম ব্যাচ) আরও ৮-১০ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এরা শুধু এই কাজের সঙ্গে জড়িত নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেকটি সংঘর্ষে নেতৃত্বে দিয়ে থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে এদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করলেও ছাত্রলীগের করার কারণে বিভিন্ন সময় পার পেয়ে যায় তারা। আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত সাড়ে ৩ বছরে ক্যাম্পাসে সংঘটিত অধিকাংশ গোলযোগের পেছনে এই ছাত্রলীগের নাম ব্যবহারকারী শিক্ষর্থীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে জানা গেছে। এই ছাত্রলীগ নেতারা পরিকল্পিতভাবে শিক্ষকদের বাসায় হামলা চালায় বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে। গতকাল মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট মো. এমদাদুল হক আমার দেশ-কে বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে নামধারী কিছু শিক্ষার্থী আমার বাসায় পাঁচবার হামলা চালায়। এ সময় বাসায় আমার ছোট দুটি সন্তান ভয়ে চিত্কার দিতে থাকে। আমার সন্তানদের আর্তচিত্কার হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, আমি এমন শিক্ষার্থীদের প্রভোস্ট হতে চাই না, যারা আমার বাসায় দফায় দফায় হামলা চালাবে। আমি পদত্যাগ করতে চাই।
গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মীর মশাররফ হোসেন হলের আশে শিক্ষকদের দুটি কোয়ার্টারে দরজা, জানালা ও বাসার আশপাশে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়। এ সময় শিক্ষকদের উদ্দেশে বিভিন্ন অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা। দৈনিক আমার দেশের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩ বছরে ব্যাপকভাবে দলীয় ও আত্মীয়করণ, পদোন্নতিতে বৈষম্য, গণহারে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অনিয়ম ও ছাত্রলীগের মূলধারার কর্মী জুবায়ের হত্যার ঘটনায় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন সে সময়ের সন্ত্রাসীদের গডফাদার অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। সর্বশেষ গত ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনে সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে প্রার্থী হন অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। নিজের সাজানো সিনেট সদস্যদের ভোট দ্বারা তিনি সর্বাধিক ভোটে জয়লাভ করেন। এরপরও তার দুর্নীতি ও স্বজনপীতির কারণে তাকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন তিনি। দেয়ালের আড়াল থেকে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার পূর্বনির্ধারিত ডিন নির্বাচনে নিজের সমর্থক শিক্ষকদের নিশ্চিত পরাজয় জানতে পেরে নির্বাচন স্থগিতের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। কাজে লাগান তার সমর্থিত ছাত্রলীগ (সাবেক ভিসিলীগ) নেতাকর্মীদের। তিনি তার অনুসারী নেতাকর্মীদের উপদেশ দেন আসন্ন ছাত্রলীগের কমিটিতে তাহমিদুল ইসলাম লিখন তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। এ কারণে তাকে যেকোনোভাবে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। এছাড়া বুধবার লিখনের নেতৃত্বে মূলধারার নেতাকর্মীরা নিহত ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে অধ্যাপক শরীফপন্থী ছাত্রলীগে নেতাকর্মীরা। পরিকল্পনা করা হয় লিখনকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়নের। এ সময় নৃবিজ্ঞান বিভাগের ৩৯তম ব্যাচের এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে লিখন ও সাদেকুল ইসলাম নাহিদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বুধবার রাত ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে জরুরি কথা আছে বলে লিখনকে আসতে বলে নাহিদ। লিখন সেখানে গিয়ে ছাত্রলীগের অধ্যাপক শরীফ এনামুলপন্থী গ্রুপের নেতা রিয়াজ মাহমুদ (সরকার ও রাজনীতি ৩৬তম ব্যাচ), বুলবুল (দর্শন-৩৭তম ব্যাচ), নাহিদসহ কয়েকজনকে দেখতে পায়। এ সময় রিয়াজ লিখনকে বলে, তোর এত বড় সাহস, তুই জুবায়েরের খুনিদের বিচার দাবিতে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করিস? কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে রিয়াজের নেতৃত্বে তারা লিখনকে ব্যাপকহারে ছুরিকাহত করে। তাকে মাঠের এক কর্নারে ফেলে যায়। এরপর মূল খেলাটা পরিচালনা করেন অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। এ ঘটনায় তার অন্ধভক্ত প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের দিয়ে নাহিদকে গ্রেফতার করানোর জন্য পুলিশকে প্ররোচিত করা হয়। পুলিশ নাহিদকে আটক করলে মীর মশাররফ হোসেন হলের ছাত্রদের ক্ষেপিয়ে দেয়া হয়। ছাত্রদের ক্ষুব্ধ করে মাঠে নামানোর দায়িত্ব পালন করেন সহকারী প্রক্টর ও মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষক আওলাদ হোসেন, সাবেক সহকারী প্রক্টর ও হলের আবাসিক শিক্ষক সাব্বির আলম। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অধ্যাপক শরীফ বুধবার দিনভর ও গভীররাতে তার বাসায় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করেন। ঠিক করেন পরিকল্পনা। তারা শিক্ষার্থীদের ব্যাপকহারে ভাংচুর ও ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করার নির্দেশ দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলেও তাদের আশ্বাস দেয়া হয়। এ আশ্বাসের পর শিক্ষার্থীরা বুধবার রাতভর ক্যাম্পাসে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। পরদিন পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পূর্বনির্ধারিত ডিন নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এর ফলে ডিন নির্বাচন স্থগিত ও লিখনকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন-দুদিক থেকে লাভবান হয় অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির। তবে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ক্যাম্পাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ। বিবৃতিতে বলা হয়, আসন্ন ডিন নির্বাচনে অধ্যাপক শরীফ তার সমর্থক শিক্ষকদের নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরেই নির্বাচন বন্ধ করার পরিকল্পনা করেন। কলা অনুষদের ডিন প্রার্থী অধ্যাপক সৈয়দ কামরুল আহসান টিটো সাংবাদিকদের বলেন, পিএসসির মেম্বার হওয়ার পরও ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে অযাচিত নাক গলান অধ্যাপক শরীফ। তার পরিকল্পনামতোই ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করে ডিন নির্বাচন স্থগিত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ভাংচুর সম্পর্কে বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয় ভাংচুর করতে পারে তারা আমাদের ছাত্র হতে পারে না।
উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে ছাত্রলীগের এক নেতাকে মারধরের ঘটনায় এক ছাত্রকে আটকের পর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে দফায় দফায় ক্যাম্পাসে ভাংচুর চালায়। এরপর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ৫ ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ১৬ ঘণ্টা ধরে ঢাকা আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। এরপর সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় ২৫ আগস্ট ক্যাম্পাস ছুটি ঘোষণা করা হয়।
সাভার প্রতিনিধি আরও জানান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে আহত করা এবং এর জের ধরে বিক্ষোভ ও ভাংচুরের ঘটনায় সাভার ও আশুলিয়া থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সাভার ও আশুলিয়া থানায় দুটি এবং আহত ছাত্রলীগ নেতার মা কাজী জোহরা বেগম সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন।
আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) মোস্তফা কামাল বলেন, দারোগা বিল্লাল হোসেনকে পিটিয়ে আহত করাসহ পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাংচুরের ঘটনায় এস আই বদরুল আলম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। এতে আসামি হিসেবে ৬ জনসহ অজ্ঞাত অনেকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates