0 ড. ইউনূসের প্রতি আক্রোশের কারণ কী


নোবেলবিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত প্রায় তিন বছর ধরে একের পর এক বৈরী আচরণ করে চলেছে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করেই ক্ষান্ত হয়নি— এখন ৬০ বছর পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বেতনভাতা গ্রহণের বৈধতা খতিয়ে দেখছে সরকার। সরকার একইসঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকতে ড. ইউনূসের ওয়েজ আর্নার্স হিসেবে কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করেছেন এবং তা বৈধ ছিল কিনা, সেটাও খতিয়ে দেখবে। গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয় দুটি খতিয়ে দেখে দ্রুততার সঙ্গে মন্ত্রিসভাকে জানাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে পৃথক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ দিনের মন্ত্রিসভার বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি নিয়োগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে গ্রামীণ ব্যাংক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০১২-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমোদিত অধ্যাদেশে এমডি নিয়োগে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়েছে। এদিকে সরকারের এই সিদ্ধান্তের পর ওই দিন এক বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক এমডি ড. ইউনূস আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত গর্বের ব্যাংকটিকে ধ্বংস করে দেবে। সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এমন বৈরী আচরণ করছে এ ব্যাপারে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কখনোই কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এর মধ্যে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বিদ্যমান এ বিষয়টি নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং ড. ইউনূসকে অপসারণ : ১৯৮৩ সালে একটি সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের সূচনা হওয়ার পর থেকেই ইউনূস এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে এলেও ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তার এমডি পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে গত বছরের ২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে অপসারণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ড. ইউনূস উচ্চ আদালতে যান; কিন্তু আদালতের রায় তার বিপক্ষে যায়। ফলে গত বছরের ১২ মে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দেন। ক্ষুদ্রঋণের উদ্যোক্তা নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসকে অপসারণ নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়; কিন্তু দেশি-বিদেশি চাপ উপেক্ষা করে সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। পাশাপাশি সামাজিকভাবে ড. ইউনূসকে হেয় করতে সরকারের উচ্চ মহল থেকে নানা পদক্ষেপ চলতে থাকে। যার সর্বশেষ উদ্যোগ হিসেবে শুক্রবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত : ২০১০ সালে ৩০ নভেম্বর নরওয়ের একটি টিভি চ্যানেলে খবর প্রচারিত হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ গ্রামীণ কল্যাণ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এ খবর প্রচারিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বছর ৫ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন। এরই মধ্যে নরওয়ে সরকার ঘোষণা দেয় বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখছে। পরে নরওয়ের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী এরিক সোলেইম সাফ জানিয়ে দেন, গ্রামীণ ব্যাংকের তহবিল সরানোর অভিযোগ তদন্তে দেখা গেছে কোনো অসত্ উদ্দেশ্যে কিংবা দুর্নীতি বা অর্থ আত্মসাতের জন্য ওই কাজ করা হয়নি। ১৯৯৮ সালে মূল তহবিলে অর্থ ফেরত দেয়ার মাধ্যমে তখন বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। নরওয়ের মন্ত্রীর ওই ঘোষণার পরও তত্পর হয়ে ওঠে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের জন্য গঠন করা হয় ৫ সদস্যের বিশেষ কমিটি।
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি : গত বছর ১২ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে ৫ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনোয়ার উদ্দীন আহমেদকে কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা, সাবেক ডেপুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল সৈয়দা রোকেয়া দীন, বিআইবিএমের সাবেক অধ্যাপক আরএম দেবনাথ এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন রশীদ। সরকারি প্রজ্ঞাপনে পর্যালোচনা কমিটি গঠনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয় । বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করায় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে। গ্রামীণ ব্যাংক স্থাপিত হওয়ার পর এর কার্যক্রম তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ ব্যাংকের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অবস্থান জানার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হলো।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন : নিউইয়র্ক টাইমসে আবারও ড. ইউনূসকে নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। গত বছর ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এ রিপোর্টে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা, ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির জনক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বিদ্বেষের বিষয় স্থান পেয়েছে। আবার কোনো সেনাসমর্থিত সরকার অথবা সামরিক সরকার এসে ড. ইউনূসকে তাদের গুরু হিসেবে বিবেচনা করুক—এ ভয়েই শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের ইমেজ ধূলিসাত্ করতে চান। নিউইয়র্ক টাইমসকে এ তথ্য জানিয়েছেন শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ হলে তাকেও শেখ হাসিনার রোষানলে পড়তে হবে আশঙ্কায় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসকে অনুরোধ জানিয়েছেন তা গোপন রাখতে। ওই কর্মকর্তা টাইমসকে আরও বলেছেন, ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকেই শেখ হাসিনার মনে হয় ড. ইউনূসের জনপ্রিয়তা যেভাবে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে এক সময় তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হবেন। এ আশঙ্কা থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক এবং তার প্রতিষ্ঠাতার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত করতে চান। তিনি ব্যাংকের নেতৃত্বে পরিবর্তন দেখতে চান। অবসরপ্রাপ্ত ওই কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ২০০৬ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর তার প্রতি শেখ হাসিনার হিংসা আরও চরম আকার ধারণ করে। তাকে পলিটিক্যাল থ্রেট হিসেবে বিবেচনা করতে থাকেন তিনি।
ফরাসি পত্রিকায় খবর : ‘ক্ষুদ্রঋণের জনক ২০০৬ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, এখানকার সরকার তার সুখ্যাতিতে বিরক্ত।’ ফ্রান্সের প্রভাবশালী দৈনিক ‘লা মঁদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদের শিরোনাম এটি। গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই দৈনিকটি প্রফেসর ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে একটি প্রতিবেদন ফলাও করে প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির বিশেষ সংবাদদাতা ফ্রেডেরিক ববিনের ঢাকা থেকে প্রেরিত জবানির একটি অংশে বলা হয়, ঢাকার সাধারণ মানুষ মনে করেন— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রফেসর ইউনূসকে একজন বড় শত্রু মনে করেন, যার কারণ ব্যক্তিগত ঈর্ষা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা এবং অকৃতজ্ঞতা।
দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ : গত ১২ তারিখ ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করা হয়েছে। ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৬ সালে ক্ষুদ্রঋণের ধারণা ও সাফল্যের জন্য নোবেল পাওয়ায় এবং ২০০৭ সালে রাজনীতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা তাকে প্রতিপক্ষ মনে করে আসছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরভিসন্ধি রয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে যেসব ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার পেছনে শেখ হাসিনা ইন্ধন দিয়ে চলেছেন। প্রতিবেদনে দারিদ্র্য বিমোচনের এই সামাজিক উদ্যোগটি গরিবের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার এক স্থূল প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় বলে উল্লেখ করা হয়ে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, ড. ইউনূসের সম্মান ভূলুণ্ঠিত না করা পর্যন্ত সরকার ক্ষান্ত হবে না।
নিউইয়র্ক টাইমসকে ড. ইউনূস : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীভাবে বর্ণনা করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শান্তিতে নোবেলজয়ী গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটা আপনি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। আমাদের কখনও সামনাসামনি দেখা হয়নি। যদিও আমি তার সাক্ষাত্ পেতে অ্যাপয়েনমেন্ট জোগাড় করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু কখনোই দেখা হলো না।’
গত বছর ২২ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক সাক্ষাত্কারে ড. ইউনূস একথা বলেন। আপনাকে সরকার কেন জোর করে সরিয়ে দিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) কখনও এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেননি।
কাজেই আমিও বুঝতে পারিনি আসলে কী ঘটছে? নানা ধরনের কিছু অনুমান সংবাদমাধ্যমগুলোতে আলোচিত হয়েছে। এ অনুমানগুলোর একটি হলো, আমি তার
প্রতি রাজনৈতিক হুমকি। আমি বুঝি না, আমি কেন রাজনৈতিক হুমকি? তিনি কখনও বলেননি, আমি তার প্রতি রাজনৈতিক হুমকি। বললে খুব সম্ভবত তিনি এমন বলতেন, ‘আমি কেন তাকে রাজনৈতিক হুমকি মনে করব? তিনি কে? তিনি কিছুই না।’
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates