
বাবা
আশা করি এখন ভাল হয়ে উঠেছো তুমি। আমি অবশ্য তেমন ভাল নেই। টাইফয়েড হয়েছিল। অসুখে পেটেও গণ্ডগোল হয়। পুরো এক সপ্তাহ জাউ ছাড়া আর কিছু খেতে পারি নি। ওই জাউ আমার মুখে রোচে না একটুও। বিছানায় শুয়ে থাকতে আর জাউ খেতে বাধ্য হয়ে মনে মনে ভাবি, ভাল হয়ে উঠে কত ভাল-মন্দ খাবার খাবো। একবার আমার খুব ইচ্ছা হয় গল্দা-চিংড়ি খেতে, তখন অনেক কিছুই মনে পড়ছিল।
তোমার ও মা’র ডিভোর্স হওয়ার পর অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। সব সময় ভাবতাম আবার স্বাভাবিক হবে সবকিছু, আবার তুমি আসবে আমাদের কাছে। কিন্তু ডিভোর্সের পর বুঝতে পারি সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। রসায়নের ভাষায় বলি, আমাকে দেখে যেতে হয় কেবল দহন। জ্বলন। এক অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়া।
সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল- তোমার সঙ্গে আমার এমন দূরত্ব সৃষ্টি হবে যে তুমি হয়তো আর আমাকে ছেলে হিসেবে দেখবে না। ডিভোর্সের ক’দিন পর তুমি ফোন করেছিলে আমাকে। বলেছিলে- এই মাত্র বাজার থেকে বড় বড় গল্দা-চিংড়ি কিনে বাসায় ফিরলে। এগুলো নিজেই তুমি রাঁধবে। আমাকে বললে তোমার ওখানে যেতে। আমাকে নিয়ে এক সঙ্গে খাবে। তুমিও জানতে, আমিও জানতাম- তা সম্ভব নয়। স্নায়ু যুদ্ধের সময় তোমার কোন ভোজনবিলাস চলতে পারে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আধ ঘণ্টা পরেই ইন্টারকমে রিং আসে। দারোয়ান জানায়, একটা তাজা গল্দা-চিংড়ি হাতে তুমি দাঁড়িয়ে আছো গেটের বাইরে। নিচে গিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাই। মজাও পাই, উত্তেজিতও হই। তুমি বললে, ‘তোমাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। তবে তোমাকে বলছি, যা-ই হোক, আমাকে কাছেই পাবে সবসময়। একদিন, নিশ্চয়ই আমরা একসঙ্গে বসে ভাল-মন্দ খাবার খাবো। আপাতত, এটা তুমি রাখো।’ তখন তুমি ওই জ্যান্ত গল্দা-চিংড়িটা তুলে দিলে আমার হাতে। সেই অদভুত দেখতে মাছটা- তার পুঁতির মতো চোখ, লম্বা বাঁকা ঠ্যাং- দেখে অনেক আশা জেগেছিল আমার মধ্যে। ভেবেছিলাম, পরিস্থিতি যা-ই হোক- তুমি সব সময়ই চেষ্টা করবে আমার জন্য। জানি তোমার ওখানে আমি সেভাবে থাকতে পারিনি- যেভাবে আমার থাকা উচিত ছিল। যখন তোমাকে ফোন করেছি তখন প্রায়ই কথা বলার মতো অবস্থায় তুমি থাকতে না। আবার তুমি থাকলেও আমি পারিনি ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে। তোমার মতো সুন্দর করে বলতে বা লিখতে তো আমি পারি না। অপারেশনের আগে তুমি যখন ঢাকায় ফিরে এলে তখন দেখতে গিয়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি। প্রতিবার তোমার ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছে গেটে। বাবাকে দেখতে গিয়ে কোন ছেলেকে প্রতিবার সিকিউরিটি গার্ডের কাছে নিজের পরিচয় জানাতে হয় না। তবে এটাও কোন অজুহাত নয়, তোমার ওখানে আমার আরও বেশি বেশি থাকা উচিত ছিল। আমি চাই এ সব কিছুর পরিবর্তন হোক। বলতে চাই, তোমাকে আমার খুব মনে পড়ে। খুব কষ্ট পাই যখন তোমাকে ইচ্ছামতো কাছে পাই না। তোমার জন্য এ চিঠি আমার গল্দা-চিংড়ি।
তোমার ছেলে, নুহাশ।