0 সুরঞ্জিতের পদত্যাগ : সরকার ও দলের বোঝা হতে চাই না বিষ খেয়ে আমি নীলকণ্ঠ হতে চাই

সুরঞ্জিতের পদত্যাগ : সরকার ও দলের বোঝা হতে চাই না বিষ খেয়ে আমি নীলকণ্ঠ হতে চাই

কাজী জেবেল
শেষরক্ষা হলো না রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের। ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বিদায় নিতে হলো তাকে। রেলভবনে গতকাল সংবাদ সম্মেলন ডেকে দুপুর ১টা ২০ মিনিটে রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও পদত্যাগপত্র পাঠান বলে জানান তিনি। রেলওয়ের চাঞ্চল্যকর ঘুষ কেলেঙ্কারির ৬ দিনের মাথায় রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হলেন সাড়ে চার মাস আগে মন্ত্রিত্ব পাওয়া সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার সময় তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। পতাকা উড়িয়ে শেষবারের মতো রেলভবনে প্রবেশ করেন। বের হয়ে যান পতাকা গুটিয়ে। তার পদত্যাগের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন মহলের মানুষ। পাশাপাশি হাজারো রেলওয়ে কর্মীসহ অনেকেই এ দাবিতেও সোচ্চার-দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির সমুচিত শাস্তি বিধান; নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং দুর্নীতিবাজদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হোক।
ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে রোববার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে তলব করে তাকে নির্দোষ প্রমাণ অথবা পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এরপরই গতকাল তিনি রেলওয়ের দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেঙ্কারির কলঙ্ক মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন। যদিও পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টা আগেও তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পদত্যাগ করবেন না। বিবিসিকে বলেছিলেন, দেশে পদত্যাগের সংস্কৃতি নেই। আমার ক্ষেত্রে পদত্যাগ করতে হবে কেন? তিনি এসব সংঘবদ্ধ চক্রান্ত বলেও দাবি করেন। তবে আগের বক্তব্য থেকে সরে এসে গতকাল তিনি বলেন, রেলওয়ের ব্যর্থতার দায়ে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে তিনি আবার রাজনীতিতে সোচ্চার হবেন বলেও জানান তিনি। প্রসঙ্গত, গত ৯ এপ্রিল গভীর রাতে বস্তাভর্তি ঘুষের টাকাসহ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক, পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলওয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা ঢাকার কমান্ড্যান্ট এনামুল হক বিজিবি’র হাতে ধরা পড়েন। এরপরই সারাদেশে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের জোরালো দাবি ওঠে এবং বিএনপি তার পদত্যাগের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দেয়।
রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর শুনে রেলভবনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের শতাধিক সাংবাদিক হাজির হন। সেখানে আগে থেকেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক সিবিএ নেতা উপস্থিত হন। গতকাল দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে রেলভবনে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বেলা ১টা ১৮ মিনিটে জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার ইঙ্গিত দেন ৭৩ বছর বয়সী প্রবীণ এ আওয়ামী লীগ নেতা। এ সময় সাংবাদিকের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। তদন্ত কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকদের সামনে আর কোনো বক্তব্য দেবেন না বলেও সাফ জানিয়ে দেন সুরঞ্জিত।
পদত্যাগের কারণ সম্পর্কে পদত্যাগী রেলমন্ত্রী বলেন, রেলওয়ের সফলতা যেমন আমার, তেমনি ব্যর্থতাও আমার ওপর বর্তায়। এই ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব নিয়ে আমি রেলমন্ত্রীর পদ থেকে অব্যাহতি নিলাম। সেই লক্ষ্যে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছি। কারণ, আমি মনে করি, এ পদত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের বিষয়টি সবার কাছে শঙ্কামুক্ত হতে পারে। রাজনীতি থেকে দূরে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আশা করি তদন্তে সত্য ও প্রকৃত ঘটনা উন্মোচিত হলে আমি নিজেকে প্রকৃত নির্দোষরূপে প্রমাণ করে আবারও রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারব। ৯ এপ্রিলের ঘটনায় নিজ দল ও সরকারের ভেতর থেকে সুষ্ঠু তদন্ত হবে কিনা—এমন প্রশ্ন উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, আমার দল (আওয়ামী লীগ) থেকেও এ ব্যাপারে প্রশ্ন আসছে। আমি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলে এ তদন্ত কাজ প্রভাবিত হতে পারে। তাই পদত্যাগ করছি। তিনি বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি সোমবার রাতে আমাকে একঘণ্টা সময় দিয়েছেন। তাকে আমি পদত্যাগের অভিপ্রায় জানাই। তিনি সানুগ্রহে তা গ্রহণ করেছেন।
রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশে-বিদেশে গত ৬ দিন রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারির বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। এ অবস্থায় গত রোববার জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তাকর্মী এনামুলক হককে সাসপেন্ড এবং মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুককে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু সবার সন্দেহের তীর মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিকে থাকায় বিভিন্ন মহল থেকে তার পদত্যাগ দাবি করা হয়। গতকাল সুরঞ্জিতের বক্তব্যে সে বিষয়টিও ফুটে ওঠে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েক দিন আগে ৯ এপ্রিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমে, সুশীল সমাজে, রাজনৈতিক মহলে এবং সর্বস্তরে একটি বিতর্কিত অবস্থান দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা কথা এসেছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা করে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করেছি রেলকে কার্যকর করা, রেলের নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা, কালোবাজারে টিকিটি বিক্রি বন্ধ করা, নতুন বগি, লাইন ও ইঞ্জিন এনে রেলকে আরও প্রসারিত করা। আমি রেলমন্ত্রী হিসেবে আন্তরিকভাবে প্রয়াস চালিয়েছি। কিন্তু ৯ এপ্রিলের ঘটনা রেলের। সেখানে আমার ব্যক্তিগত সহকারী ও রেলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কর্মকর্তা এবং কর্মচারী এতে নিয়োজিত ছিল। সুতরাং এই দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। দুঃখ করে বলতে হয়, বিগত ৪০ বছরে আমরা শুধু গণতন্ত্রের সুবিধা ভোগই করেছি। গণতন্ত্রের সঙ্কটে কেউ আত্মত্যাগ করতে আসেনি। জীবনের সায়াহ্নে এসে আমি সেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি। আমি বলিষ্ঠভাবে বলতে চাই, ওই ঘটনার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি আজকে গণতন্ত্রকে পরিশীলিত ও পরিমার্জিত করার জন্য (পদত্যাগের) সিদ্ধান্ত নিতে চাইছি। অতীতেও আমার জীবনে এরকম অনেক সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি। কখনও নিঃসঙ্গভাবে নিয়েছি আবার কখনও পাশে বন্ধু-বান্ধব পেয়েছি। আজকে আমি নিঃসঙ্গভাবে দায়িত্ব নিতে চাই।
সরকারের বোঝা হতে চান না মন্তব্য করে তিনি বলেন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই ঘটনার পর মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকা সমীচীন নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। আমি তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি বলেন, শৈশব থেকেই চ্যালেঞ্জ সৃষ্টির রাজনীতি করে আসছি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নতুন মাত্রা যোগ করতে আমি অনেক নিঃসঙ্গ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকে একটি সঙ্কটময় রাজনীতির মুহূর্তে আমি একটি দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। আমার সামনে কঠিন পথ—যেনতেন প্রকার সব আলোচনা-সমালোচনাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অথবা দল, সরকার এবং সরকারপ্রধানের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য চ্যালেঞ্জ নেয়া। দেশের প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করার সুযোগ সবার জীবনে আসে না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইতিহাস সৃষ্টি করার দুঃসাহস অনেকে দেখায় না। আমি ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় পথ বেছে নেয়াকে সমীচীন মনে করেছি। তিনি বলেন, সমুদ্র মন্থনে শুধু অমৃত আছে তা নয়, বিষও আছে। গণতন্ত্রে দুটোই হয়। আজ আমি বিষ পান করে নীলকণ্ঠ। আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই—দল, সরকার এবং দলের নেত্রীর কাছে আমি বোঝা হতে চাই না। আমি তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হোক সেটাই চাই।
পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সব সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ছিল। কখনও নিজেই সংবাদ সৃষ্টি করে সহযোগিতা করেছি। কখনও কখনও নিজেই সংবাদের শিরোনাম হয়েছি। আজ আবারও শিরোনাম হয়ে আপনাদের সহযোগিতা করলাম। উপস্থিত সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে তার বক্তব্য শেষে বলেন, আজকে আমি কোনো প্রশ্ন নেব না, কোনো প্রশ্নের উত্তরও দেব না। আপনাদের সবার সহযোগিতা ও সহমর্মিতাই আমি কামনা করি। আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সংবাদ সম্মেলনে রেলের মহাপরিচালক আবু তাহের ও সচিব ফজলে কবির উপস্থিত ছিলেন।
যে কারণে পদত্যাগে বাধ্য হলেন : রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের জিএম (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তাকর্মী এনামুল হক ৯ এপ্রিল গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকাসহ ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর হাতে ধরা পড়েন। প্রায় ১২ ঘণ্টা বিজিবির হাতে আটক থাকার পর রেলমন্ত্রীর চাপে ১০ এপ্রিল দুপুরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তারা জানান, ওই টাকাসহ রেলমন্ত্রীর জিগাতলার বাসায় যাচ্ছিলেন এবং তাদের অপহরণ করার লক্ষ্যেই চালক আলী আজম গাড়িটি বিজিবির গেটে ঢুকিয়ে দেন। এরপর বিজিবি সদস্যরা তাদের টাকাসহ আটক করেন। পরে এপিএস ও রেল কর্মকর্তারা ছাড়া পেলেও চালক আলী আজম এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। জানা যায়, রেলওয়েতে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার পদে নিয়োগবাণিজ্যের মন্ত্রীর ভাগের একটি অংশ প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা তার জিগাতলার বাসায় পৌঁছে দিতে যাওয়ার সময় তারা আটক হন। এ খবর দৈনিক আমার দেশসহ গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে সরকারি দলের একাধিক এমপি, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ, সাধারণ মানুষসহ বিভিন্ন মহল থেকে রেলমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তোলে। রোববার বিরোধীদলীয় সংসদীয় কমিটি সুরঞ্জিত সেনের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। একইদিন রাতে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে তাকে জরুরি তলব করেন। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী তাকে দুটি অপশন দেন। এক. নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করা; দুই. পদত্যাগ করা। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ না করেই পদত্যাগ করলেন।
ঘটনাপ্রবাহ : ৯ এপ্রিল গভীর রাতে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার, রেলওয়ের জিএম (পূর্বাঞ্চল) ইউসুফ আলী মৃধা ও ঢাকার কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ৭০ লাখ টাকাসহ ঢাকায় বিজিবির হাতে ধরা পড়েন। প্রায় ১২ ঘণ্টা বিজিবির হাতে আটক থাকার পর রেলমন্ত্রীর চাপে ১০ এপ্রিল দুপুরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। ঘটনা তদন্তে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। মন্ত্রীর এপিএস ওমর ফারুক তালুকদার ও রেলের জিএম বিজিবির কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংবাদ সম্মেলন করে জানান, এ টাকার মালিক তার এপিএস। তিনি এপিএসের গাড়িচালককে এ ঘটনার জন্য দায়ী করে বলেন, ওমর ফারুক ব্যক্তিগত টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় চালক তাকে অপহরণ করে। তবে এপিএস ফারুক ও জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ওইদিন সাংবাদিকদের জানান, সরকারি কাজে তারা জিগাতলায় মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, সোমবার গভীর রাতে টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় ওমর ফারুকের চালক তাকে অপহরণের চেষ্টা করে। এ সময় ভয়ে জীবন বাঁচাতে তিনি বিজিবি সদর দফতরের ভেতরে প্রবেশ করেন। ওমর ফারুকের কাছে কীভাবে এত টাকা এলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিজের টাকা নিজের সঙ্গে রাখার বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা ঠিক নয়। কারণ তার টাকা তিনি কোথায় রাখবেন, নিজের সঙ্গে রাখবেন—নাকি বাসায় রাখবেন, তা তার ব্যাপার। তবে কোনো অন্যায় আছে কিনা, তা তদন্ত করলেই বের হয়ে আসবে। ১১ এপ্রিল এপিএস ওমর ফারুককে সাসপেন্ড করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১২ এপ্রিল এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে কেলেঙ্কারির ঘটনায় পদত্যাগ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে এক মুহূর্তও দেরি করবেন না বলে জানান তিনি। এপিএস ও রেল কর্মকর্তাদের বিপুল পরিমাণ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়ার ঘটনাকে তার বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আমি বিপদে পড়ে গেছি। সামনে ঢাকা সিটি করপোরেশন। এ অবস্থায় সরকার ও মন্ত্রীদের বিব্রত করতে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এ চক্রান্ত করছে। রেল কর্মকর্তারা তার বাসায় যাচ্ছিলেন না দাবি করে তিনি বলেন, ওইদিন রাত ১০টায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। মধ্যরাতে আমার বাসায় যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এপিএস ফারুকের বাসা মোহাম্মদপুরে। তারা ওই দিকেই যাচ্ছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেউ কি রাত ১২টার সময় মন্ত্রীর বাসায় যায়। এভাবে কি মন্ত্রীকে টাকা দেয়। তিনি বলেন, তাদেরকে বিজিবি থেকে ছাড়িয়ে আনার লোক আমি নই। রাত ১০টায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। তাদের সঙ্গে রাত ১২টায় সাক্ষাত্ করার প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক জীবনে অনেককে তীর মেরেছি; কিন্তু তীরের ব্যথা সহ্য করিনি মন্তব্য করে তিনি বলেন, অতীতে যেভাবে তীর ছুঁড়েছি, বাকি জীবন ছুঁড়ব। এবার তীর আমার দিকে। এতে কী যে ব্যথা—তা আমি বুঝতে পারছি। আশা করি এ ঘটনায় সবাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে কথা বলবেন। পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন রাজনীতিবিদের জন্য পদ অর্জন করা সাংঘাতিক কোনো বিষয় নয়, ত্যাগ করাও সহজ। যদি অবস্থান ওদিকে নিয়ে যায়, তবে (পদত্যাগ করতে) এক মুহূর্ত সময় নেব না। আমি রাজনীতিবিদ। আমার কাছে মন্ত্রিত্ব পাওয়া বড় কথা নয়। মন্ত্রিত্ব যাওয়া বা পদত্যাগ করা আমার কাছে খুবই স্বাভাবিক জিনিস। ১৫ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তাকর্মী এনামুল হককে সাসপেন্ড এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এপিএসকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। রেলওয়ের নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্ত করা হবে। রাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গণভবনে যান এবং গতকাল ১৬ এপ্রিল পদত্যাগ করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
রেলওয়েতে সুরঞ্জিতের শেষদিন যেভাবে কাটল : মন্ত্রিত্বের শেষদিন রেলওয়ে ভবনে দু’ঘণ্টা অবস্থান করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ সময় তিনি সংবাদ সম্মেলন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দু’দফায় বৈঠক ও তার ভক্তদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটান এবং রেলওয়ে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। পুরো সময় তাকে বিমর্ষ ও মলিন দেখাচ্ছিল। গতকাল দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে পতাকাবাহী রেলওয়ের কালো রংয়ের পাজেরো গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো-ও ০০-০৩৭৮) চড়ে মন্ত্রী হিসেবে শেষবারের মতো রেল ভবনে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বেরিয়ে আসেন বিকাল ৩টায়। একই গাড়িতে আবার বাসায় ফিরলেও পতাকা গুটানো ছিল। সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও বিস্কিট রঙের মুজিব কোট পরিহিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের চেহারায় আগের মতো হাস্যোজ্জ্বল ভাব ছিল না। বিমর্ষ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে থাকা সাথীরা অশ্রুসজল চোখে তার সঙ্গে রেল ভবনে প্রবেশ করেন। বেলা ১টা ০৫ মিনিটে রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) শাজাহান, রেলওয়ে সচিব ফজলে কবিরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। বেলা ১টা ১৮ মিনিটে রেলওয়ের সভাকক্ষে অপেক্ষমাণ শত শত সাংবাদিকের সামনে হাজির হন তিনি। সেখানে মাত্র ১৫ মিনিটের একটি লিখিত বক্তব্য দেন। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবার নিজ কক্ষে চলে যান। সেখানে বেশ ক’জন রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। তাদের অনেকেই তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুপুর ১টা ৫৮ মিনিটে রেল ভবনের ৬ তলায় অবস্থিত কনফারেন্স রুমে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে তিনি রেল কর্মকর্তাদের কাছে বিদায় চেয়েছেন এবং রেলওয়েকে গতিশীল করতে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপর নিজ রুমে কিছু সময় কাটিয়ে বেলা ৩টার দিকে রেল ভবন থেকে বের হয়ে জিগাতলার বাসায় চলে যান। জিগাতলার বাসার গেটে গতকালও পুলিশ প্রহরা ছিল। বিবিসি সংবাদদাতা কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুরঞ্জিত কথা বলতে রাজি হননি। রাতে বাসাতেই অবস্থান করেছেন তিনি।
মন্ত্রিত্ব রক্ষায় যত চেষ্টা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের : ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় নিজের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকার প্রমাণ ও মন্ত্রিত্ব রক্ষায় সব চেষ্টা করেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। একইসঙ্গে দোষী কর্মকর্তাদেরও রক্ষার চেষ্টা চালান তিনি। আর এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১০ এপ্রিল নিজ কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দুই কর্মকর্তার বিজিবির হাতে আটক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সোমবার গভীর রাতে টাকা নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় ওমর ফারুকের চালক তাকে অপহরণের চেষ্টা করে। এ সময় ভয়ে জীবন বাঁচাতে তিনি বিজিবি সদর দফতরের ভেতরে প্রবেশ করেন। উদ্ধার হওয়া টাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ওই টাকার মালিক এপিএস ওমর ফারুক। তাদের শাস্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের অপরাধ নিরূপণের আগে শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না। রিপোর্ট পেলে স্পষ্ট হবে তারা অপরাধী কিনা। তারপরই ব্যবস্থা। এর একদিন পরই তদন্ত কার্যক্রম চলা অবস্থায় এপিএস ওমর ফারুক সাসপেন্ড করা হয়। গত ১৫ এপ্রিল ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হককে সাসপেন্ড ও এপিএসকে চাকরিচ্যুত করা হয়। প্রথমে বিজিবির হাতে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আটকের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এটি ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র। মন্ত্রী প্রথম দিন উদ্ধার হওয়া টাকার মালিক এপিএস ফারুকের দাবি করেন। পরবর্তীতে তিনি তার সে অবস্থান থেকেও সরে আসেন। গত ১৫ এপ্রিল রেলমন্ত্রী বলেন, মধ্যরাতে আমার বাসায় যাওয়ার কোনো কারণ নেই। এপিএস ফারুকের বাসা মোহাম্মদপুরে। তারা ওই দিকেই যাচ্ছিল। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, কেউ কী রাত ১২টার সময় মন্ত্রীর বাসায় যায়। এভাবে কী মন্ত্রীকে টাকা দেয়। ওই টাকা কোথায় যাচ্ছিল তা বের করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের বিজিবি থেকে ছাড়িয়ে আনার লোক আমি নয়। রাত ১০টায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। তাদের সঙ্গে রাত ১২টায় সাক্ষাত্ করার প্রশ্নই আসে না। এপিএস বেসরকারি কর্মকর্তা। তারা কোথায় কী করে তার দায়িত্ব মন্ত্রী নিতে পারে না। গতকাল এ ঘটনার দায় স্বীকার করেই পদত্যাগ করেন তিনি।
৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মহাবিপর্যয় : ১৯৪৫ সালে ৫ মে বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার সেন পরিবারে জন্ম নেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। এ হিসাবে বর্তমানে তার বয়স ৬৭ বছর। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলভবনে নিজ কার্যালয়ে গত ১২ এপ্রিল আমার দেশকে বলেন, তার বয়স ৭৩ বছর। রাজনৈতিক বয়স ৫৫ বছর। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মহাবিপর্যয়ে পড়েছেন তিনি। জীবনে প্রথমবার মন্ত্রিত্ব পেলেও সাড়ে চার মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ থেকে প্রাদেশিক পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন সুরঞ্জিত। এরপর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে বড় দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচনে হারের স্বাদ নিতে হয় তাকে। পরবর্তীতে হবিগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হয়ে আসেন তিনি। এরপর ২০০১ ও ২০০৯ সালেও এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
ছাত্র ইউনিয়নের যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন ১৯৬৫ সালে। সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে পেশাজীবন শুরু করেন আইনজীবী হিসেবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দলে সংস্কারের দাবি তুলে কর্মীদের বিরাগভাজন হন। গত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তাতে ‘সংস্কারপন্থী’ হিসেবে তার ঠাঁই হয়নি। পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়ে তার স্থান হয় ক্ষমতাহীন উপদেষ্টা পরিষদে। বিভিন্ন সময়ে নানা মন্তব্য করে রাজনীতিতে বেশ আলোচিত ছিলেন প্রবীণ এ নেতা। বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না মন্তব্য করে হৈ চৈ সৃষ্টি করেন। গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রী হয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, রেলের কালো বিড়ালটি আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে, বলেছিলেন, আমি শেষ বেলার মন্ত্রী। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির পর সালমান এফ রহমানকে দায়িত্ব দিলে সুরঞ্জিত সেনের মন্তব্য ছিল- ‘শুঁটকির হাটে বিড়াল চৌকিদার’। বাকপটু সুরঞ্জিত দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম বড় ধরনের চাপে পড়ার কথা স্বীকার করে গত ১২ এপ্রিল বলেন, ‘এতদিন তীর ছুড়ে এসেছি, এখন নিজেই তীরবিদ্ধ। তীরের যন্ত্রণা যে কী তা বুঝতে পারছি। কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে...। গতকাল সর্বশেষ তার মন্তব্য- ‘বিষ খেয়ে আজ আমি নীলকণ্ঠ’।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নেননি সুরঞ্জিত : সচিবালয়ে গতকাল মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক ছিল। গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রীর শপথ নেয়ার পর থেকে নিয়মিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিয়েছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। গতকাল ছিল ব্যতিক্রম। মন্ত্রিসভার গতকালের বৈঠকে তিনি অংশ নেননি। বৈঠক শেষে মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, ব্যক্তিগত কারণে বৈঠকে অংশ নিতে না পারার কথা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আগেই মৌখিকভাবে জানিয়েছেন।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates