0 দুর্নীতির দায় কীভাবে এড়াবেন মন্ত্রীরা

দুর্নীতির দায় কীভাবে এড়াবেন মন্ত্রীরা : নিয়োগবাণিজ্য টেন্ডারসহ নানা কেলেঙ্কারি

কাদের গনি চৌধুরী
শুধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই নন, আরও একডজনেরও বেশি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির ভয়াবহ অভিযোগ। কোনো কোনো মন্ত্রীর দুর্নীতির সূচক সুরঞ্জিতের চেয়েও অনেক বেশি। এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। প্রমাণসহ তা উপস্থাপনও করা হয়েছে। এরপরও তিনি আছেন বহালতবিয়তে। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছেন সারাদেশ। শুধু মন্ত্রীই নন, সরকারদলীয় অর্ধশত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। এসব অভিযোগ করেছেন স্বয়ং সরকারি দলের নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করে তার প্রমাণও পেয়েছেন। অথচ এখনও কোনো ব্যবস্থা নেননি তিনি।
মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চাকরি দেয়ার নামে ঘুষ কেলেঙ্কারিই বেশি। অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ। কারও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আপসরফার মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তি বাজারমূল্যের চেয়ে বহুগুণ কম মূল্যে পছন্দের লোকের হাতে তুলে দেয়া। কোনো কোনো মন্ত্রী কাজ না করে কিংবা পণ্য না কিনে ঠিকাদারের মাধ্যমে ভুয়া বিল করে টাকা উত্তোলনের মতো মহাকেলেঙ্কারিও করেছেন।
ফারুক খান : বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী এ মন্ত্রী নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন। বিদ্যুত্ খাতের প্রকল্পে
একচ্ছত্র আধিপত্য ফারুক খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বর্তমান সরকারের সময় ২ হাজার ২শ’ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজের বেশিরভাগই করায়ত্ত করেছে বর্তমান বিমানমন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রীর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুেকন্দ্রের কাজ।
সূত্র জানায়, তিনটি বৃহত্ বিদ্যুেকন্দ্রসহ মোট ৮টি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজ পেয়েছে সামিট। বিবিয়ানা-১, বিবিয়ানা-২ এবং মেঘনাঘাট-২, এ ৩টি বিদ্যুেকন্দ্রের প্রতিটির উত্পাদন ক্ষমতা ৩৩০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট। তিনটির কাজই পেয়েছে সামিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশন লিমিটেড। সঙ্গে নামকাওয়াস্তে রাখা হয়েছে মার্কিন কোম্পানি জিই এনার্জিকে। আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) নীতিমালা অনুযায়ী স্থাপিতব্য এ তিনটি কেন্দ্রের ক্ষেত্রেই সামিটের অংশীদারিত্ব ৮০ শতাংশ। আর আমেরিকান কোম্পানি জিই এনার্জি এলএলসির ২০ শতাংশ। সরকার ২২ বছর ধরে এই কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুত্ কিনবে। এ তিনটি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে ব্যয় হবে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা।
মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার এক বছর পর বিনা দরপত্রে ‘কুইক রেন্টাল’ বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের হিড়িক পড়লে সামিট গ্রুপ নারায়ণগঞ্জের মদনগঞ্জে বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কাজে অযোগ্য ঘোষিত হয়। তারপরও পিডিবিকে দিয়ে তাদের প্রস্তাবের বৈধতা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হয়। পরে সামিট মদনগঞ্জে ১০২ মেগাওয়াট ‘কুইক রেন্টাল’-এর কাজ পেয়েছে। খুলনা পাওয়ার কোম্পানির ১১৫ মেগাওয়াট ও নোয়াপাড়ায় খানজাহান আলী পাওয়ারের ৪০ মেগাওয়াট ‘কুইক রেন্টাল’ও সামিটের। এছাড়াও সামিট ফার্নেস অয়েলে চালিত সৈয়দপুর ১০৪ ও শান্তাহার ৫২ মেগাওয়াট আইপিপির কাজ পেয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বৃহত্ বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বিনিয়ানা বিদ্যুেকন্দ্রের ক্ষেত্রে সামিট-জিই এনার্জি ক্ষমতার জোরে প্রাক-যোগ্যতা অর্জন করে। পরে দাতা সংস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। নতুন করে বিবিয়ানা ৩৩০-৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রাক-যোগ্যতার প্রস্তাব আহ্বান করা হলে ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল ৭টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের যোগ্যতার দলিলপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে ৪টি প্রতিষ্ঠানকে প্রাক-যোগ্য বিবেচনা করা হলেও ৩টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দলিল (আরএফপি-রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) কেনে। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাব দাখিল করে। মূল্যায়নে পরিকল্পিতভাবে মালয়েশিয়ার ওয়াইটিএল পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল বারহাডকে ননরেসপনসিভ ঘোষণা করা হয়। সামিট-জিই জেভিকে বিবিয়ানা বিদ্যুেকন্দ্রের একমাত্র বৈধ প্রস্তাবদাতা করার পরিকল্পনা থেকেই এটা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ, প্রধান উদ্যোক্তা (লিড স্পন্সর) হিসেবে সামিটের এ ধরনের বৃহত্ বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের পূর্বঅভিজ্ঞতাই নেই।
বিবিয়ানা ৩৩০-৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুেকন্দ্রের (দ্বিতীয় পর্যায়) জন্য গত বছরের ২ মে ১২টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্যতার দলিলপত্র দাখিল করে। ৮টি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্য প্রতিষ্ঠানের ৫টি দরপত্র দলিল (আরএফপি) কিনলেও ১৪ অক্টোবর মাত্র ৩টি দরপত্র জমা হয়। নানা কারসাজি ও ছলচাতুরির মাধ্যমে এ কেন্দ্রের কাজও সামিটকে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ড. হাছান মাহমুদ : প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত স্নেহভাজন এ মন্ত্রী শুরুতে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পরে তাকে পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। জলবায়ু তহবিল নয়-ছয় করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও বহাল তবিয়তে আছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড থেকে তার পছন্দের এনজিওগুলোর প্রকল্প তিনি অনুমোদন দিচ্ছেন। এসব এনজিওর বেশিরভাগই অদক্ষ বলে অভিযোগ রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে কাজের ক্ষেত্রে এগুলোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এসব এনজিওর বেশির ভাগেরই কর্ণধার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বলে জানা গেছে।
এদিকে পরিবেশ অধিদফতর দুর্নীতির বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে যে কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র নেয়া ও ছাড়পত্রের নবায়নে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘুষ ছাড়া পথ নেই। এ অধিদফতরে ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ‘ওপেন সিক্রেট’। এখানে ঘুষ ছাড়া শিল্পের পরিবেশসংক্রান্ত ছাড়পত্র পাওয়া যায় না, ছাড়পত্রের নবায়নও হয় না। শিল্প-কারখানার নতুন ছাড়পত্রের জন্য এবং প্রাপ্ত ছাড়পত্র নবায়নের জন্য দিতে হয় মোটা অংকের টাকা ঘুষ। এমনকি ইটভাটা থেকেও মন্ত্রণালয়ের নাম করে ঘুষ নেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নামে ভাটাপ্রতি ১৫ হাজার টাকা চাঁদা চেয়ে পাবনার বিভিন্ন ইটভাটার মালিককে চিঠি দেয়া হয়েছে। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্যাংকের পাবনা শাখায় ওই চাঁদার টাকা জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়েছে। এমনকি চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হলে র্যাব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে ইটভাটা মালিকদের শাসিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে পাবনা জেলা প্রশাসনের দ্বারস্ত হলে প্রশাসন এ চক্রকে কোনো টাকা বা চাঁদা না দেয়ার জন্য ইটভাটা মালিকদের পরামর্শ দিয়েছে।
জানা গেছে, সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শেখ শোয়েবুল আলম স্বাক্ষরিত একটি চিঠি পাবনা জেলার দেড় শতাধিক ইটভাটা মালিক বরাবর ইস্যু করা হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্ব জলবায়ু পরিস্থিতিতে সামপ্রতিক বছরগুলোতে অনেক ভীতিকর প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে। এ জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় তহবিল গঠনের জন্য ২৪ এপ্রিলের মধ্যে ১৫ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। এ ছাড়া টাকা জমা দেয়ার রসিদ নম্বর বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ভ্রাম্যমাণ আদালতকে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
চিঠিতে কোনো অ্যাকাউন্ট নম্বর উল্লেখ না থাকলেও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট স্লিপ সরবরাহ করা হয়েছে। চিঠির সঙ্গে সরবরাহকৃত ওই স্লিপটিতে অ্যাকাউন্ট নম্বর ১৩৭.১০১.১৭৩৬৬৩; অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নাম মাইনুল ইসলাম। কিন্তু ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাকাউন্টটি ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট। সরকারি বিধি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা জমা দেয়ার কোনো বিধান নেই। এর আগে এ ধরনের চিঠি সিরাজগঞ্জ ইটভাটা মালিকদের কাছেও পাঠানো হয়েছিল।
জাহাঙ্গীর কবির নানক : স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে আসেন না বললেই চলে। গত সাড়ে তিন বছরে মন্ত্রী অফিস করেছেন মাত্র ৫৯ দিন। ফলে গোটা মন্ত্রণালয় প্রতিমন্ত্রী নানকের নিয়ন্ত্রণে।
এলজিইডিতে টেন্ডার প্রক্রিয়ার পরতে পরতে যেমন হচ্ছে দুর্নীতি, তেমনি অভ্যন্তরীণ নানা কার্যক্রমেও বেশুমার দুর্নীতি ঘটে চলছে। ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্প জালিয়াতি, আর্থিক দুর্নীতি, ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে রাস্তাঘাট ও সরকারি ভবন তৈরির নামে হরিলুট, ভুয়া প্রকল্প বানানোসহ বিভিন্ন নিত্যনতুন কৌশল আবিষ্কার করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড়। নির্ভরযোগ্য সূত্র ও অনুসন্ধানে এলজিইডির এসব দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এলজিইডির একটি সূত্র জানায়, বৃহত্তর ঢাকার ৫ জেলায় ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণ করেই কাগজ-কলমে ২৩টি ভবন নির্মাণের টাকা তুলে নেয় দুর্নীতিবাজরা। ভয়াবহ এ দুর্নীতির ঘটনা তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে ১ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া নির্দেশও উপেক্ষা করা হয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি তো পাননি উল্টো পদোন্নতি পেয়েছেন।
স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর নিজ এলাকার রাস্তাঘাট, ফুটপাত উন্নয়নে গত এক বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ওয়ার্ক প্যাকেজ অনুমোদন এবং ব্যয় নিয়ে লুটপাট ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। হিসাবের খাতায় উন্নয়ন ব্যয় দেখিয়ে বিল তুলে নিলেও এসব রাস্তাঘাট ও ফুটপাত ছোট খাল- নালাই রয়ে গেছে।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত সাড়ে বছর ধরে ডিসিসির রাস্তাঘাট, ফুটপাত ও নদর্মা উন্নয়নে সরকারের কাছে অর্থ সহায়তা চেয়ে গ্রহণ করা প্রকল্পে থেকে শুধু মোহাম্মদপুর এলাকার জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়ে ছাড় দেয়া হয়েছে।
একইভাবে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট বিভিন্ন প্রকল্পে উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাট হচ্ছে। ফাইল প্রস্তুতের জন্য সক্রিয় রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর ভবনে একটি সিন্ডিকেট। আর এসব দুর্নীতির সঙ্গে প্রকল্পের প্রকৌশলীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে উন্নয়নের নামে বছরে কমপক্ষে ৬৫০ কোটি টাকার দুর্নীতি হচ্ছে।
জানা গেছে, বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি আড়াল করতে এলজিইডির দুর্নীতিবাজ একটি চক্র ঢাকা, খুলনা, বরগুনাসহ কয়েকটি জেলার প্রকল্পের নথিপত্র যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করেনি। অনেক ক্ষেত্রে বিল ভাউচারের পর্যাপ্ত তথ্যও সংশ্লিষ্ট নথিতে সংরক্ষণ করা হয়নি। টেন্ডার খোলার কাগজপত্র ও দরপত্রের সঙ্গে দরপত্রের জামানতের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রস্তুতকৃত বিবরণীতে নেই। এমনকি দরপত্র কমিটির সভার বিবরণীও এলজিইডির দাফতরিক নথিতে সংরক্ষণ করা হয়নি। অনেক দরপত্রের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র গৃহীত হয়নি। সরকারি অর্থ ব্যয়ের সঠিক হিসাবও সংরক্ষণ করা হয়নি। পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেয়ার লক্ষ্যে বড় পত্রিকায বিজ্ঞাপন না দিয়ে অখ্যাত কিছু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে,পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কাজ বরাদ্দ নেয়ার পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের টাকা অপচয় করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই সম্পন্ন দেখিয়ে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে এ অভিযোগ এনে ভুক্তভোগীরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ এলজিইিডির প্রধান প্রকৌশলীর দফতরে অসংখ্য আবেদন করেছেন। গত সাড়ে তিন বছরে ১২৭ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয় এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করে কমিটি। কিন্তু এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সূত্র জানায়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এলজিইডি গাজীপুর জেলার রাস্তাঘাট সংস্কার ও রোড কাটিংয়ের কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাত্ করা হয়। গাজীপুরের এক প্রকৌশলী সরকারি কোষাগারের এক কোটি ছয় লাখ টাকা সরকারি ব্যাংক হিসাবে জমা না দিয়ে নিজের ব্যাংক হিসাবে জমা দেন। অন্যদিকে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-২১ এর সব অর্থ ব্যয় না করে আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। উন্নয়ন কাজ শেষে রাজস্ব খাতের অবশিষ্ট ১০ কোটি টাকা কোষাগারে জমা না দিযে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তত্কালীন প্রকল্প পরিচালকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব, পূবালী ব্যাংক ফার্মগেট শাখায় (এসটিডি-৩৪) এসব টাকা জমা রাখা হয়। একই ঘটনা ঘটেছে বৃহত্তর ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রকল্প হিসেবে ২৩টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন নির্মাণে। প্রতিটির জন্য পিপিতে বরাদ্দ ছিল ৩৫ লাখ টাকা। ২৩টি ভবনের মধ্যে মাত্র ১১টি তৈরি করলেও অবশিষ্টগুলো নির্মাণ করা হয়নি। প্রায় ২০০ কোটি টাকার আট বছর মেযাদের (২০০২-২০০৯ পর্যন্ত) এই প্রকল্পের সিংহভাগই লোপাট হয়েছে।
সূত্র মতে, ঢাকা অঞ্চলে শুধু রোড কাটিং প্রকল্পেই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সারাদেশে স্কুল-কলেজ, ইউপি ভবনসহ সরকারি ভবন নির্মাণ, সড়ক তৈরি ও মেরামতের নামে ঘটছে বেশুমার দুর্নীতি। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও সড়ক সংস্কার প্রকল্পে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে বলে জানা যায়। ঘুষ ছাড়া কোনো প্রকল্প গতি পায় না। আবার এক প্রকল্প করার নামে টাকা আত্মসাত্ করতে কাল্পনিক প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেয়ারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। টেন্ডার কেলেঙ্কারির ঘটনা তো ঘটছে অহরহ। ভুয়া বিল তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৌশলী-ঠিকাদার মিলে মিশে প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগি করে নেন।
ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী : দেশের বিদ্যুত্ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হীরক রাজা হিসেবে খ্যাত ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত্ ও জ্বালানিবিষয়ক এ উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাট। কারা বিদ্যুত্ প্লান্ট পাবে, কে কতটা পাবে, দর কী হবে—তা সবই হয় তার ইচ্ছায়। এ উপদেষ্টাকে সামিট গ্রুপের খাস লোক বলে জানেন সবাই। আমেরিকান কিছু গ্যাস কোম্পানিরও তিনি খাস মেহমান।
ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের নামে তার একান্ত আপন ব্যবসায়ীদের হাতে বিদ্যুত্ খাত তুলে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলেও এ মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি বিদ্যুত্ কোম্পানিকে ময়মনসিংহে ৭০ মেগাওয়াটের একটি প্লান্ট দেয়া হয়, যার জন্য ব্যয় হয়েছিল ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অথচ একই ক্ষমতাসম্পন্ন ফেঞ্চুগঞ্জের প্লান্ট পিডিপি ৩৫ মিলিয়ন ডলারে নির্মাণ করা হয়। এ ঘাপলার রহস্যময় তাত্পর্য নিয়ে নানা কথা উঠেছিল।
বিদ্যুত্ মন্ত্রণালয়ের শাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বীর বিক্রম দায়িত্ব গ্রহণের পর আগুন লেগে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘোড়াশাল ও আশুগঞ্জ বিদ্যুত্ প্লান্ট সচলে আগ্রহী নন। তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুই বেসরকারি খাতে নতুন নতুন প্লান্ট তার পছন্দের কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া।
অভিযোগের অন্ত নেই জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহীর বিরুদ্ধে। ঘুষ গ্রহণ, বিনা দরপত্রে কাজ দেয়া, চুক্তি করে তা গোপন রাখা, বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে আঁতাতসহ বিভিন্ন দুর্নীতির সঙ্গে তার জড়িত থাকার বিষয়টি সর্বত্র আলোচিত। সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী উপদেষ্টা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে ওঠা কোনো অভিযোগেরই তদন্ত হয় না। অভিযোগ করে বা প্রতিবাদ জানিয়ে উল্টো শাস্তি পেতে হয় অভিযোগকারী বা প্রতিবাদকারীকে।
সূত্রমতে, মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনকে বিনা দরপত্রে ৩৭০ কোটি টাকায় মুচাইয়ে একটি কম্প্রেশার বসানোর প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী অনুমোদনের পরও পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করে বলেন, বিবিয়ানা ও জালালাবাদ ক্ষেত্রের মজুত অনুযায়ী আগামী ১০ বছরে মুচাইয়ে গ্যাসের চাপ কমবে না। এছাড়া কম্প্রেশার বসানোর পর গ্যাসের চাপ যে পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার কথা প্রকল্প সারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তা এখনই সেখানে রয়েছে। তাই ৩৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে কম্প্রেশার স্থাপন অযৌক্তিক ও অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। শেভরনের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা এ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তবে অজ্ঞাত কারণে পেট্রোবাংলার তত্কালীন চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মোক্তাদির আলী শেভরনের পক্ষে অবস্থান নেন। অন্যদিকে পেট্রোবাংলার পরিচালক ইউসুফ আলী তালুকদার বিষয়টির তীব্র বিরোধিতা করে লিখিত আপত্তি জানান। এ নিয়ে তার সঙ্গে পেট্রোবাংলার তত্কালীন চেয়ারম্যানের তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়। পরে ইউসুফ আলী তালুকদারকে ওএসডি করে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীন করা হয়।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান : নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনেছেন স্বয়ং যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সরকারদলীয় একাধিক সদস্য। তাদের অভিযোগ, নৌমন্ত্রী সড়ক পরিবহন সেক্টরকে জিম্মি করে রেখেছেন। মন্ত্রী শাজাহান খান ও তার অনুসারীদের অত্যাচার-নির্যাতনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) কাজ করতে পারছে না। বিষয়টি সম্পর্কে তারা কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করারও চিন্তা-ভাবনা করছেন। সরকারের প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এনে কমিটির সদস্যরা বলেন, তার দুর্নীতির বিষয়টি কারও অজানা নয়।
সম্প্রতি সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে সংসদ ভবনের মিডিয়া সেন্টারে কমিটির সদস্য সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি ও ওমর ফারুক চৌধুরী প্রেস ব্রিফিংয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে এসব অভিযোগ তোলেন।
নৌমন্ত্রী শাজাহান খান অনেক আগ থেকে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে একজন বড় মাপের পরিবহন ব্যবসায়ী ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। ঢাকা-মাদারীপুর রুটসহ ঢাকা শহরের কয়েকটি রুটে তার পরিবহন ব্যবসা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে।
সংসদীয় কমিটির ওই বৈঠকের পর গোলাম মাওলা রনি বলেন, প্রভাবশালী মন্ত্রী শাজাহান খানের শ্রমিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় বিআরটিএ ও বিআরটিসি কাজ করতে গিয়ে পদে পদে বাধা পাচ্ছে। মন্ত্রীর শ্রমিক সংগঠনের নামে বিভিন্ন স্থানে বিআরটিসির গাড়ি ভাংচুর করা হচ্ছে। যেসব রুটে বিআরটিসির বাস চলাচল করা দরকার, সেসব রুটে তা করতে দেয়া হচ্ছে না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দুটিকে একেবারে অকেজো করে রাখা হয়েছে। তার শ্রমিক সংগঠনের কারণে প্রতিষ্ঠান দুটি কোনো কাজ করতে পারছে না। দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক সংগঠনের চাঁদাবাজি বন্ধে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও ওই মন্ত্রীর (শাজাহান খান) কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
সৈয়দ আবুল হোসেন : বর্তমান সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীদের নাম আসতেই প্রথমে আসে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের নাম। তার দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ। শুধু বাংলাদেশের মিডিয়াই নয়, পদ্মা সেতু নিয়ে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে। তার দুর্নীতি নিয়ে বোমা ফাটানো তথ্য ফাঁস করে দেয় উইকিলিকসও।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ঘুষ বা কমিশন চেয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা। আবুল হোসেনের নাম ব্যবহার করে অর্থ চাওয়া হয়েছে। কমিশন দিলে কাজ পেতে যোগাযোগমন্ত্রী নিজেই সহায়তা করবেন বলেও আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পর পর সাকো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদ থেকে অব্যাহতি নেন আবুল। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা হলেন মন্ত্রীর স্ত্রী খাজা নার্গিস হোসেন এবং দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেন। অথচ যোগাযোগমন্ত্রী এ সাকোকে কমিশন এজেন্ট করার জন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে চাপ দেন। এজন্য তিনি ভয়ভীতিও দেখান। বিশ্বব্যাংক বিস্তারিত তদন্ত করে যোগাযোগমন্ত্রীর এসব দুর্নীতির তথ্য সরকারকে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনটি সরকারকে দিয়ে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে, এ অবস্থায় পদ্মা সেতুতে অর্থ পেতে হলে বাংলাদেশকে এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো ঋণ ছাড় করা হবে না। বিশ্বব্যাংকের অনড় অবস্থান এবং দেশব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলে গত ৫ ডিসেম্বর আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে বিদায় নিতে হয়। অবশ্য মন্ত্রণালয় হারালেও মন্ত্রিত্ব হারাননি। তাকে দেয়া হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
এদিকে রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ইটাল-থাই’র বাংলাদেশী এজেন্ট এখন কে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী শিকদার গ্রুপের পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, ইটাল-থাই’র বাংলাদেশী এজেন্ট যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কোম্পানি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দরপত্রে অংশগ্রহণকারী শিকদার-কেসিসি জেভির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, অস্বচ্ছতার মাধ্যমে কারিগরিভাবে তাদের অযোগ্য দেখানো হয়েছে। কারিগরি প্রস্তাব পুনরায় মূল্যায়নের দাবি উপেক্ষা করে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার কাজটি দেয়া হয়। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে মূল্যায়ন করার দাবিও আমলে নেয়া হয়নি। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ ইটাল-থাইকে দেয়ার কারণে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগ মূল্যায়ন কমিটির বেশিরভাগ সদস্যই যোগাযোগমন্ত্রীর অধীনস্থ হওয়ায় যোগ্য প্রতিষ্ঠান অবিচারের শিকার হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়া চলাকালে প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম সচিব মো. আবদুল কাদিরকে সরিয়ে এমএ ওয়াদুদকে বসানো নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। দরপত্র মূল্যায়নে বড় ধরনের কারসাজি হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও অভিযোগ করা হয়, গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর মন্ত্রী সিঙ্গাপুর হয়ে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার পথে ব্যাংককের নভোটেল-লোটাস হোটেলে ইটাল-থাই’র সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর ইটাল-থাই বাংলাদেশে মফিজ আহমেদ ভূঁইয়ার এজেন্সি বাতিল করে। ইটাল-থাই স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে স্থানীয় বিড বন্ড দিয়েছে। এতেও বিদেশি এ কোম্পানির সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে বলে জানানো হয়। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যোগাযোগমন্ত্রী। তিনি বলেন, তার কাজে অস্বচ্ছতা নেই। আর ইটাল-থাই’র সঙ্গে তিনি যুক্তও নন।
যমুনা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সিআরবিসি নামের কালোতালিকাভুক্ত একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন তত্কালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। কিন্তু তার এই ইচ্ছায় বাদ সাধে মিডিয়া। ব্যাপক লেখালেখির পর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কালোতালিকাভুক্ত কোম্পানিকে কাজ দেয়ার প্রস্তাবের সমালোচনা করে প্রথম দফায় তা বাতিল করে দেয়। পুনঃদরপত্রে যে কোম্পানিটিকে ৭৭ কোটি টাকা বেশি দরে কাজ দেয়া হয়েছে, সেটিরও স্থানীয় প্রতিনিধিত্বে মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী দাবি করেছেন, নতুন করে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠান সাকোর কোনো সম্পর্ক নেই।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান : নদী-খাল ড্রেজিং, ক্লোজার-শহররক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও নদীতীর রক্ষার নামে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের অভিযোগ আসছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে। অর্থ লোপাটের অভিযোগ যেমন আছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে, তেমনি অভিযোগ এসেছে খোদ পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে কাজ না করে টাকা উত্তোলন, প্রকল্প ব্যয় চার-পাঁচগুণ বেশি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাত্, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ইত্যাদি।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এনে মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মো. গোলাম মাওলা রনি। পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনকে পাঠানো ডিও লেটারে পটুয়াখালী-৩ আসনের এ সংসদ সদস্য গলাচিপা উপজেলার চরকাজল ইউনিয়নের মায়ারচর খালে ক্লোজার নির্মাণে সরকারি অর্থ লুটপাটের চিত্র তুলে ধরে অবিলম্বে এ প্রকল্প বন্ধের অনুরোধ জানান।
ডিও লেটারের শিরোনাম ছিল—‘গলাচিপা উপজেলার চরকাজল ইউনিয়নের মায়ারচর খালে ক্লোজার নির্মাণে অনিয়ম, সরকারি অর্থ লুটপাট, অপচয় এবং জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে’। চিঠিতে পানিসম্পদমন্ত্রীকে ‘প্রিয় সহকর্মী’ সম্বোধন করে বলা হয়, ‘আমার নির্বাচনী এলাকার মায়ারচর খালে ক্লোজার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। জনস্বার্থে এ কাজটি বন্ধ করা দরকার। কারণ এ ক্লোজার নির্মাণ হলে ১. সংশ্লিষ্ট এলাকার এক হাজার একর জমিতে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে; এতে ১০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হবে। ফলে জুন-জুলাই মাসে ক্লোজারটি কেটে দেয়া ছাড়া জনগণের আর কোনো উপায় থাকবে না। এতে রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হবে। ২. আপনার দফতরের ক্ষমতাধর ব্যক্তি (প্রতিমন্ত্রীর নাম সরাসরি উল্লেখ না করে) ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত লোভ-লালসার কারণে পটুয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ড তড়িঘড়ি করে জনৈক ব্যক্তির (প্রতিমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে) মনোনীত ঠিকাদার নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে। ৩. জনস্বার্থবিরোধী এ ক্লোজার নির্মাণের কারণে গণঅসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ৪. উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই ক্ষমতাধর ব্যক্তি (প্রতিমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে) প্রশাসনের সহায়তায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ এবং পুলিশি পাহারা বসিয়ে ক্লোজার নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে।’ চিঠিতে তিনি অনতিবিলম্বে কাজ বন্ধ, স্লুইস গেটসহ ক্লোজার নির্মাণ ও টেন্ডারে অনিয়ম তদন্তের সুপারিশ করেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লাগামহীন দুর্নীতি : দলীয়করণ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নিয়োগবাণিজ্যে স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্যখাত। চিকিত্সকরা জনগণকে সেবা দেয়ার চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকছেন দলবাজি ও নিজ নিজ ব্যবসা নিয়ে। দলবাজ চিকিত্সকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়ে বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ চিকিত্সকরা সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন ক্লিনিকে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিত্সককে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছে মফস্বলের এমনসব হাসপাতালে, যেখানে কোনো যন্ত্রপাতিই নেই। বড় হাসপাতালগুলোতে দলীয় বিবেচনায় অনভিজ্ঞ চিকিত্সকদের নিয়োগ দেয়ায় ভুল চিকিত্সায রোগী মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। ফলে ভারত ও ব্যাংককমুখী হয়ে পড়ছেন রোগীরা। যাদের দেশের বাইরে গিয়ে চিকিত্সাসেবা নেয়ার সামর্থ্য নেই, কেবল তারাই দেশে চিকিতত্সা করাচ্ছেন।
স্বাস্থ্যখাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে চলছে চরম দলীয়করণ, অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগবাণিজ্য। সরকার সমর্থক চিকিত্সক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের মধ্যে আধিপত্যের লড়াইয়ের কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অকার্যকর হয়ে আছে। যতই দিন যাচ্ছে, নৈরাজ্য ও অনিয়মে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রতিদিনই অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্যের অভিযোগ আসছে মন্ত্রণালয়ে। এর বেশিরভাগই আসছে সরকার সমর্থক চিকিত্সকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাচিপের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যায় না।
বিভিন্ন হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি সবই হচ্ছে স্বাচিপের কথামত। ভিন্নমতের চিকিত্সক থেকে শুরু করে হাসপাতালের সুইপার পর্যন্ত কেউ তাদের নিপীড়ন থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ভিন্নমতের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের মফস্বলে পাঠানোর পর সেখানেও যোগদান করতে দেয়া হচ্ছে না।
বর্তমান সরকারের আমলে স্বাস্থ্যখাতে নিয়োগবাণিজ্য, বদলি, দুর্নীতি-অনিয়ম সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। স্বাস্থ্য বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক চিকিত্সক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদ (স্বাচিপ), বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) এবং মন্ত্রী-উপদেষ্টা ও প্রভাবশালী আমলাদের অনুসারীরা এসবের সঙ্গে জড়িত। বিশেষ করে, ২০১০ সালে স্বাস্থ্যখাতে নিয়োগবাণিজ্য দেশ-বিদেশে ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দেয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে ওই পদে ৬ হাজার ৩৯১ জনকে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়োগে তখন কোটি কোটি টাকার ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। একইভাবে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে কর্মচারী নিয়োগ নিয়েও ওই বছর সারাদেশে মহাহট্টগোল দেখা দেয়। ২০১০-এর অক্টোবরের মধ্যে দেশের প্রায় সব জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ১২ হাজার কর্মচারী নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু এ নিয়োগেও ঘুষবাণিজ্য এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় সিভিল সার্জনের অফিস ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। পাবনায আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পছন্দমত লোক নিয়োগ দিতে রাজি না হওয়ায় সেখানে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মারধর ও পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে।
শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া : বাম রাজনীতিক দিলীপ বড়ুয়ার বিবুদ্ধেও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। যমুনা সার কারখানার কোটি কোটি টাকা লুটপাট আড়াল করতে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়াকে ৯১ লাখ টাকা দামের গাড়ি ও দুটি এসি উপঢৌকন দেয় সেখানকার দুষ্ট চক্রটি। মিত্সুবিসি কোম্পানির দামি এ গাড়ি এবং দুটি এয়ারকন্ডিশনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার অফিসে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। গাড়ির নম্বর জামালপুর ১১-০০২০। তবে মন্ত্রী গাড়ির চাবি বুঝে পাওয়ার আগেই এ নিয়ে দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত তিনি গাড়িটি আর নেননি। বিনিময়ে অন্য কিছু নিয়েছেন কি না তা জানা যায়নি।
সূত্র জানায়, গত বছরের ২০ এপ্রিল থেকে যমুনা সার কারখানা বন্ধ করে ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ওভারহোলিংয়ের কাজ শুরু হয়। এ ওভারহোলিংয়ের নামে শ্রমিক নিয়োগ ও মালামাল কেনা বাবদ কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার উপস্থিতিতে এ অভিযোগ উত্থাপন করেন। যমুনা সার কারখানা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) এক অভিষেক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী তারাকান্দিতে এলে মঞ্চে তার উপস্থিতিতেই বক্তৃতায় এসব অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। কিন্তু মন্ত্রী ওভারহোলিংয়ের নামে দুর্নীতি বিষয়ে কোনো মন্তব্যই করেননি।
জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. শহিদুল্লাহ এবং স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো ওই সময় সাংবাদিকদের জানান, ওভারহোলিংয়ের নামে কোটি কোটি টাকা লুটপাট আড়াল করতেই মন্ত্রীকে এসব উপঢৌকন দেয়া হয়। এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ বলেন, ওভারহোলিংয়ের নামে যমুনা সার কারখানায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়। এ টাকা ভাগ হয় সিবিএ এবং বিসিআইসির সর্বস্তরের কর্মকর্তার মধ্যে।
?রাশেদ খান মেনন : ছাত্রজীবন এবং যৌবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় তিনি ব্যয় করেছেন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করে। স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড তার অতীতের এ উজ্জ্বল অবদানকে ম্লান করে দিয়েছে। এখন নিজ দলের নেতাকর্মীসহ দেশের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও বিতর্কিত। তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের পাহাড় জমেছে। বিশেষ করে রাজধানীর দুটি সেরা স্কুল ভিকারুন নিসা ও আইডিয়ালে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার ভর্তি-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
রেজাউল করিম হীরা : অনিয়ম আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, জলমহাল-বালুমহাল ইজারা, খাসজমি বন্দোবস্ত, নামজারি, জরিপ এবং মাঠ পর্চা প্রণয়ন থেকে শুরু করে সর্বত্রই চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতি। এই মন্ত্রীর ছেলে এবং মন্ত্রণালয়াধীন বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই এসব সংঘটিত হচ্ছে।
জানা গেছে, ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরার ছেলে ও মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং ক’জন পিও’র নেতৃত্বে গোটা মন্ত্রণালয় পরিচালিত হয়ে আসছে। জলমহাল, বালুমহাল, জমি বন্দোবস্ত কিংবা বদলি বা পদায়ন—তাদের ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছু করার সাধ্য নেই। ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে বিগত দিনে দেলোয়ার হোসেনের মতো জাঁদরেল সচিবকেও বদলি হতে হয়েছে। নিয়মের বাইরে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় আতাহারুল ইসলামের মতো সত্ ও অভিজ্ঞ সচিবকেও ওএসডি হতে হয়েছিল।
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়াধীন ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরটি দুর্নীতির আখড়া হিসেবে চিহ্নিত করে। সম্প্রতি সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা ভূমি মন্ত্রণালয় এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। শিগগিরই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এ প্রতিবেদন দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, সংশ্লিষ্ট মহলের আশীর্বাদপুষ্ট একটি চক্র গত তিন বছর ধরে সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের উপসচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেকশনের কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন। গত আড়াই বছরে তাদের তুষ্ট না করায় অনেক সংসদ সদস্যের জলমহাল ইজারা পেতে বেগ পেতে হয়েছে। এমনকি যাচাই-বাছাইপূর্বক সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিস থেকে নির্দিষ্ট সমিতির অনুকূলে জলমহাল বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ করলেও ওই সিন্ডিকেটচক্রের ইশারায় অন্য সমিতিকে জলমহাল বরাদ্দ করা হয়েছে।
এমন ঘটনা সিলেট, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ প্রায় ৭০-৮০টি সমিতির ক্ষেত্রে ঘটেছে। এছাড়াও জলমহাল ইজারা প্রদান সংক্রান্ত বিভিন্ন জেলার বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল গায়েব হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার একটিরও সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি বলে জানা গেছে।
গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সরকারদলীয় এমপি জিয়াউর রহমানের নির্বাচনী এলাকার জলমহাল ইজারা সংক্রান্ত ডিও লেটার গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে জলমহাল ইজারা সংক্রান্ত সভায় এমপির ডিও লেটারের বাইরে ওই জলমহাল ইজারা দেয়া হয়। এ ঘটনায় এমপি জিয়াউর রহমান ক্ষুব্ধ হন। ইজারা বাতিল করার জন্য ওই সংসদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী ও প্রতিন্ত্রীকে ডিও লেটার দেন। জলমহাল প্রকৃত মত্স্যজীবীদের দেয়া হয়নি বলে তিনি (ওই সংসদ সদস্য) সরাসরি প্রতিবাদ করেন।
কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। শুধু তাই নয়, ভূমিমন্ত্রীর ছেলের নাম ভাঙিয়ে বাণিজ্য চলছে বালুমহাল ও খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়ার ক্ষেত্রেও। সরকারদলীয় অনেক সংসদ সদস্যের সুপারিশও ধোপে টেকে না। ভূমি মন্ত্রণালয়ে টাকা ছাড়া কোনো ফাইল নড়ে না বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
সূত্রমতে, এ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জলমহাল, বালুমহাল, খাসজমি বন্দোবস্তসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন মন্ত্রী। কিছুদিন যেতে না যেতেই তার ছেলের দুর্নীতি কার্যক্রম শুরু হতে থাকে। বিষয়টি খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী ভূমিমন্ত্রীকে সতর্ক করেন।
মন্ত্রণালয়ে এরই ধারাবাহিকতায় তত্কালীন ভূমি সচিব দেলোয়ার হোসেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যেক কর্মকর্তার কক্ষ খোলা রাখার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ কিছুদিন পালন করতে দেখা গেলেও রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। এদিকে সম্প্রতি অপর একটি গোয়েন্দা সংস্থা ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের দুর্নীতির বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করেছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় দুর্নীতি চলছে।
আবদুল লতিফ বিশ্বাস : মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস। রেলওয়ের মতো এখানেও কোটি কোটি টাকার নিয়োগবাণিজ্য হয়ে গেছে গত ৪ মাস আগে। মন্ত্রীর এপিএসের মাধ্যমে এ নিয়োগবাণিজ্য সম্পন্ন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, ডিসেম্বরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় ৪০০ পদে লোক নিয়োগ দেয়া হয়। এর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণীর প্রায় তিনশ’ আর বাকি একশ’ নিয়োগ দেয়া হয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তৃতীয় শ্রেণীর পদের জন্য জনপ্রতি ৫ লাখ এবং চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির জন্য ঘুষ নেয়া হয় ৩ লাখ টাকা করে। এ চারশ’ কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে প্রায় ১৭ কোটি টাকা ঘুষ নেয়া হয় বলে সূত্র জানায়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন প্রকল্পে পিডি নিয়োগে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ে সহকারী পরিচালক/জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা/সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার পদে পদোন্নতি দিতে গিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ঘুষ নেয়া হয়। এখন পোস্টিংয়ের জন্য আরেক দফা ঘুষ দাবি করা হচ্ছে। যার ফলে পদোন্নতি পাওয়ার তিন মাস পরও কারও পোস্টিং হচ্ছে না।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী : বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। এখানে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ক্রেতাদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে সরকারি মিলের জমি বিক্রি, বেশি দাম দেখিয়ে পাট ক্রয় এখানে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
গত সাড়ে ৩ বছরে এ মন্ত্রণায়ের অধীন বিভিন্ন সংস্থায় আড়াই হাজারেরও বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর প্রায় সব নিয়োগই হয়েছে অর্থের বিনিময়ে। শুধু বিজেএমসিতেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে দেড় হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এতে প্রায় একশ’ কোটি টাকা ঘুষ নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও পাট ক্রয় দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচারে টাকা আত্মসাত্, দুর্নীতি ঢাকতে পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়া, ছুটিতে গিয়ে উচ্চ বেতনে বিদেশের পাটকলে চাকরি, চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও চাকরিতে বহাল থাকা, গবেষণার নামে অর্থ আত্মসাত্সহ নানা অনিয়ম বাসা বেঁধেছে পাট মন্ত্রণালয়ে। অব্যাহত দুর্নীতির কারণে লোকসানের পাল্লা ভারি হচ্ছে এ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিজেএমসির। গত অর্থবছরেও প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দেয় ২১৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে ৭৭২টি অডিট আপত্তি উঠেছে পাট মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে। এ পর্যন্ত মাত্র ১৯টি আপত্তি নিষ্পন্ন হয়েছে।
বিজেএমসির অধীন বাংলাদেশ জুটমিলের রৌমারী ক্রয়কেন্দ্রের চলতি হিসাব নম্বর ১৩৯০ ও ১৩৯১ জনতা ব্যাংকের শাখা থেকে ২০১১ সালে পাঁচটি টিটির মাধ্যমে সিরাজগঞ্জের বাসুদেব দাস ও তার প্রতিষ্ঠান দুর্গা উইভিং ফ্যাক্টরির নামে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। পাট সরবরাহ না করলেও বাসুদেব দাসকে এ টাকা দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বাসুদেব বিজেএমসির চেয়ারম্যান টিডি মিত্রের ভাগ্নে বলে জানা গেছে।
যশোর কার্পেটিং জুটমিলের মজুরি বিভাগের প্রধান লোকমান ও ক্যাশিয়ার ফারুক হোসেন ভুয়া বিল-ভাউচারে ৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা আত্মসাত্ করেছেন। বিষয়টি অডিটে ধরা পড়লেও মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে তা মওকুফের চেষ্টা চলছে।
লতিফ বাওয়ানি জুটমিলের গুদামে ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে আগুন লাগে। পরে বিটিএমসির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহমুদ উল আলম তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। অভিযোগ রয়েছে, ২০ কোটি টাকা আত্মসাত্ করার জন্য আগুনের ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত। এসব বিষয়ে পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে উপকমিটি গঠন করে।
পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে দুর্নীতি চলছে সমানতালে। ইনস্টিটিউটের কেনাকাটা ও ভবন নির্মাণের কাজ নিয়ে চলছে কমিশনবাণিজ্য। পাটের জিন রহস্য নিয়ে পরিচালিত প্রকল্পেও চলছে পুকুর চুরি। এ প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ের অডিট হবে না—এমন নির্দেশনা থাকায় ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গোপন আঁতাতের মাধ্যমে টঙ্গীতে কাদেরিয়া টেক্সটাইলের ৫শ’কোটি টাকার ১১ একর জায়গা মাত্র ১২৮ কোটি টাকায় বিক্রির চক্রান্ত চলছে। একইভাবে জয়কালী মন্দির এলাকায় তিন একরের আরেকটি জায়গা মাত্র ৮৫ কোটি টাকায় বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ এ জায়গার বর্তমান বাজারমূল্য রয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
ড. আবদুর রাজ্জাক : অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির পাহাড় জমেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। সুপারিশ ছাড়া কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এখন আর কাজ দেয়া হয় না। আবার ঠিকাদারির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলেও মন্ত্রণালয়ের পছন্দের কারণেই একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হচ্ছে বারবার। প্রতিষ্ঠানটি কাজ না পেলে পুনঃটেন্ডারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর ছোটখাটো টেন্ডারগুলোতে এখন টাঙ্গাইলের মন্ত্রীর এলাকার ঠিকাদার ছাড়া অন্য কেউ সেখানে হাত বাড়াতে পারে না। খাদ্য গুদাম নির্মাণেও দুর্নীতির সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। লোক নিয়োগেও চলছে তুঘলকি কাণ্ড। মন্ত্রণালয়ের তালিকা না পাওয়ায় লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে।
খুলনার মংলায় সাইলো নির্মাণ নিয়েও বড় ধরনের দুর্নীতির চক্রান্ত করা হয়েছে। এসব অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রণালয়ের ভেতরে-বাইরে। আর পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য হচ্ছে, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি-অনিয়মে কোনো রাখঢাক নেই।
উন্নয়নের নামে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা টিআর ও কাবিখা প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন। কাবিখার চাল-গম বিক্রি হয়েছে কালোবাজারে। দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে অনেক প্রকল্পের গম ফেরতও গেছে। কোথাও প্রকল্প সম্পন্ন না করে, আবার কোথাও ৪০ ভাগ কাজ করে প্রকল্পের পুরো বিল উত্তোলন করা হয়েছে। কাবিখা প্রকল্পে শুধু ঘাস কেটেই পুরো টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিজ নির্বাচনী এলাকায়। হরিলুট হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচিতে। এসব কর্মসূচির ২০ ভাগ সুবিধা ভোগ করছেন স্বয়ং ডিলার ও স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের আত্মীয়স্বজনরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, এসবই হচ্ছে আওয়ামী লীগে ‘ক্লিন ইমেজ’ খ্যাত খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের সামনেই। এমনকি সরকারের এই আড়াই বছরে বেশকিছু অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও প্রতিকারের তেমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারেননি তিনি। এ কারণে ক্রমেই দুর্নীতির বিষবৃক্ষে পরিণত হতে যাচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মংলায় সাইলো নির্মাণ নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতির চক্রান্ত চলছে। সাইলো নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় প্রায় ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পকে এখন ৩৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
খাদ্য গুদাম নির্মাণেও ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। খোদ খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ১৪০টি খাদ্য গুদাম নির্মাণের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় এসব গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। কমিটির একজন সদস্য জানান, গুদামগুলোর নির্মাণ কাজে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, খাদ্য গুদাম নির্মাণে মন্ত্রণালয়ের পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বারবার কাজ দেয়া হচ্ছে। অথচ ওই প্রতিষ্ঠানটি কাজ পাওয়ার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেনি। এছাড়া চট্টগ্রামের হালিশহরে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সরকারি খাদ্য সংরক্ষণাগার কেন্দ্রীয় খাদ্য গুদামে (সিএসডি) এক লাখ পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ৯১টি গুদাম নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেট এ কাজ করছে।
সূত্র জানায়, হালিশহরে সিএসডির নতুন গুদাম নির্মাণে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ পেয়ে সম্প্রতি খাদ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক একেএম এনায়েত হোসাইন নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে যান। তিনি নির্মাণাধীন বিভিন্ন গুদামের প্যাকেজে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার সত্যতা পান। এনায়েত হোসাইন পরিদর্শনকালে ১৭ নম্বর প্যাকেজের গুদাম নির্মাণ কাজে খুব নিম্নমানের ইট ও কঙ্কর ব্যবহার করতে দেখেন। তিনি ওই প্যাকেজের সাইট ইঞ্জিনিয়ারসহ অন্য কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা এসব সামগ্রী সরিয়ে নেয়া হবে বলে তাকে জানান। এরপর ঠিকাদারের লোকজন মহাপরিচালককে পরীক্ষার জন্য কিছু ইট দিলে তিনি সেগুলো ঢাকায় নিয়ে পরীক্ষা করে তাতেও নিম্নমানের ইটের প্রমাণ পান।
খাদ্য অধিদফতরে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চতুর্থ শ্রেণীর প্রায় এক হাজার ৮০০ লোক নিয়োগের নামে এরই মধ্যে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। কিন্তু এবার সংসদ সদস্যরা দলীয় বিবেচনায় প্রার্থী নিয়োগের জন্য মন্ত্রণালয়ে তালিকা পাঠান। ফলে সিন্ডিকেটের প্রার্থীদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের তালিকার গরমিল দেখা দেয়। এ অবস্থায় সংসদ সদস্যদের তালিকাকে প্রাধান্য দিয়ে চাকরি দিলে অগ্রিম টাকা হাতিয়ে নেয়া সিন্ডিকেটটি বিপদে পড়ার আশঙ্কা করে। তারা মন্ত্রীকে নানা ধরনেরভুুল বুঝিয়ে ফলাফল ঘোষণায় কালক্ষেপণ করতে থাকে।
সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয় থেকে পছন্দ লোকদের নামের তালিকা এখনও না পাওয়ায় লোক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়াটিই আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। লোক নিয়োগের এই কেলেঙ্কারিতে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকজন জড়িত বলে সূত্র জানিয়েছে।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে টেস্ট রিলিফ (টিআর) এবং দুস্থদের সহায়তায় নেয়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে বছরজুড়েই। খোদ খাদ্যমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে বিস্তর অভিযোগ এলেও তেমন প্রতিকার মেলেনি। তবে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কাবিখার বেশকিছু কাজ বন্ধ করে দিয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
৫০ এমপি : সরকারদলীয় ৫০ জনেরও বেশি সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল, নিয়োগ-বাণিজ্য, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন তারা। এসব অভিযোগের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সূত্রমতে, গত সাড়ে তিন বছরে নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারদলীয় যেসব সংসদ সদস্যের নাম বারবার ওঠে এসেছে তাদের মধ্যে আছেন আবদুর রহমান বদি (কক্সবাজার-৪), এম আবদুল লতিফ (চট্টগ্রাম-১০), ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা (ঢাকা-১৬), গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ময়মনসিংহ-১০), অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (ময়মনসিংহ-৪), সোলায়মান হক জোয়ার্দার (চুয়াডাঙ্গা-১), শেখ আফিল উদ্দিন (যশোর-১), গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্স (পাবনা-৫), মনিরুল ইসলাম মনির (বরিশাল-২), মোশতাক আহমেদ রুহি (নেত্রকোনা-১), জাহেদ মালেক স্বপন (মানিকগঞ্জ-৩), মোয়াজ্জেম হোসেন রতন (সুনামগঞ্জ-১), মাহাবুব আরা বেগম গিনি (গাইবান্ধা-২), মো. ফজলে রাব্বী মিয়া (গাইবান্ধা-৫), মো. ইসরাফিল আলম (নওগাঁ-৬), ওমর ফারুক চৌধুরী (রাজশাহী-১), মো. শাহরিয়ার আলম (রাজশাহী-৬), জুনাইদ পলক (নাটোর-৩), মো. জয়নাল আবেদীন (মেহেরপুর-১), মো. খালেদুর রহমান টিটো (যশোর-৩), খান টিপু সুলতান (যশোর-৫), আবদুল ওহাব (যশোর-৬), এস কে আবু বাকের (নড়াইল-২), শেখ হেলাল উদ্দীন (বাগেরহাট-১), মো. সোহরাব আলী সানা (খুলনা-৬), আ. স. ম ফিরোজ (পটুয়াখালী-২), আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব (ভোলা-৪), মো. শাহ আলম (পিরোজপুর-২), অধ্যাপক ডা. এমএ মান্নান (কিশোরগঞ্জ-২), হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫), একে এম রহমতুল্লাহ (ঢাকা-১০), কামাল আহমেদ মজুমদার (ঢাকা-১৫), তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ (ঢাকা-১৯), আলহাজ অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী (গাজীপুর-৩), আবদুল্লাহ-আল কায়সার (নারায়ণগঞ্জ-৩), মো. আবদুর রহমান (ফরিদপুর-১), মুহিবুর রহমান মানিক (সুনামগঞ্জ-৫), শফিকুর রহমান চৌধুরী (সিলেট-২), আ হ ম মুস্তফা কামাল (কুমিল্লা-১০), ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (চট্টগ্রাম-১), এবিএম আবুল কাশেম (চট্টগ্রাম-৩), নুরুল ইসলাম বিএসসি (চট্টগ্রাম-৮), আখতারুজ্জামান চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১২) ও সুলতানা তরুণ (কুষ্টিয়া-৪) প্রমুখ।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates