0 রানুর যে বক্তব্য নিয়ে সংসদে উত্তেজনা

রানুর যে বক্তব্য নিয়ে সংসদে উত্তেজনা

সংসদ রিপোর্টার
গতকাল জাতীয় সংসদের বৈঠকে বিএনপির সংসদ সদস্য রেহানা আক্তার রানুর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে কিছু সময়ের জন্য সংসদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকারের নানা কর্মকাণ্ড ও ব্যর্থতাকে অত্যন্ত কঠোর ও তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করে বক্তব্য দেয়ার একপর্যায়ে সরকারি দলের একাধিক মহিলা সদস্য উচ্চস্বরে হৈচৈ শুরু করেন। তারা ধমক দিয়ে বক্তব্য বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। বিএনপির অপর মহিলা সদস্য শাম্মি আক্তার সরকারদলীয় সদস্যদের বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ করার একপর্যায়ে হাতাহাতির উপক্রম হয়। একে অপরকে ‘চুপ’ বলে শাসান। এ সময় সরকারদলীয় অন্য সদস্যও দাঁড়িয়ে তুমুল হৈ চৈ ও চিত্কার করে রানুর বক্তব্যকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালান। বিকাল ৫টা ৫৮ মিনিট থেকে ৫ মিনিট এ উত্তেজনা ছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ বর্জনের পর বিরোধী দলের যোগদানের দিনে রেহানা আক্তার রানুর বক্তব্যকে ঘিরে উত্তেজনার রেশে গতকাল রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের ওপর আর কেউ বক্তব্য দেননি। সরকার ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ, জাসদ সদস্য মইনউদ্দিন খান বাদল রানুর বক্তব্যের পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন। রানুর বক্তব্য যথারীতি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘সংসদ টিভি’তে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
রেহানা আক্তার রানুর যে বক্তব্যকে কেন্দ্র করে গতকাল জাতীয় সংসদ অধিবেশ উত্তপ্ত ও দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হয় ওই বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো:
মাননীয় স্পিকার, দিন বদলের কথা বলে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। সরকারের তিন বছর শেষ। হানিমুন পিরিয়ডও অনেক আগেই শেষ হয়েছে। অনেকে বলেন নৌকার তলা নাকি ফুটো হয়ে গেছে। আজ জিনিসপত্রের এত দাম, মানুষ সহ্য করতে পারছে না। আজ সারাদেশে ক্ষুধার্ত মানুষের কণ্ঠ ধ্বনিত হচ্ছে। এ কেমন দিন বদলের শুরু হলো পালা, পেটে বড় ক্ষুধার জ্বালা, আমাদের দাবি—কবে তোরা যাবি, যা দূর হ’ শালা।
মাননীয় স্পিকার, আজ শেয়ারবাজার হয়েছে মানুষের মরণের বাজার। শেয়ারবাজারের টাকা লুট করে আমেরিকা, কানাডা, লন্ডনে পাচার করা হয়েছে। আজ পুঁজি হারিয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছে। মাননীয় হুইপ কিছুক্ষণ আগে বক্তব্যে বলেছেন, উনারা অনেক বিদ্যুত্ দিয়েছেন। এত বিদ্যুত্ গেল কোথায় মাননীয় স্পিকার। শিল্প কলকারখানা বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুত্ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। চারিদিকে অন্ধকার। ফেনী নদী আমাদের নদী। এটা আন্তর্জাতিক নদী নয়। আজ পাম্প বসিয়ে ভারত সেখান থেকে জোর করে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। সরকার নির্বিকার কোনো প্রতিবাদ করছে না। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যে ওই অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। মাননীয় স্পিকার, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে ভাষণ দিয়েছেন সে ভাষণে এসব সমস্যা সমাধানের কোনো কথাই তিনি উল্লেখ করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা লিখে দিয়েছেন, উনি তোতা পাখির মতো বুলি আওড়িয়েছেন। সেটি বাস্তবতা বিবর্জিত, বস্তাপচা গল্প। বাংলাদেশে যা ঘটছে তার কোনো প্রতিফলন এ ভাষণে নেই। তাই আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।
মাননীয় স্পিকার, কিছুক্ষণ আগে হুইপ সাহেব বক্তব্যে বলেছেন, জামায়াতের কথায় নাকি বিএনপি চলে। এটি অসত্য। বিএনপি চলে বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে। আমি উনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই—১৯৯১ সালে আপনাদের নেত্রী গোলাম আযমের পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন। আর ছিয়ানব্বই সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আপনারা এক সঙ্গে আন্দোলন করেছেন। (এ সময় তুমুল হৈচৈ শুরু করেন সরকারদলীয় সদস্যরা।) এর মধ্যেই রানু বলেন, জামায়াত যখন আপনাদের সঙ্গে যায় তখন হয় সঙ্গী, যখন আমাদের সঙ্গে আসে তখন হয় জঙ্গি। মাননীয় স্পিকার, কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। কথা বলতে এসেছি। এতদিন তারা এক তরফা বলেছে। আমরা আসিনি। আজকে কথা বলার সুযোগ না দিলে আমরা ওয়াকআউট করতে বাধ্য হব। (তুমুল উত্তেজনা, বিএনপির শাম্মি আক্তার ও আওয়ামী লীগের ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী মুখোমুখি। কয়েকজন তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন।)
স্পিকার : যার যার আসনে আপনারা বসুন।
রানু : এখানে আমরা কথা বলার জন্য এসেছি। কথা আমরা বলবই মাননীয় স্পিকার।
মাননীয় স্পিকার, কাল নাগিনীর কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ডায়নির কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। আইনের শাসনের পরিবর্তে চলছে জংলি শাসন। দানবের শাসন চলছে। আইন-আদালত প্রধানমন্ত্রীর ভ্যানেটি ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আমরা দানবের শাসন নয়, মানবের শাসন চাই। মাননীয় স্পিকার, আদালতকে দিয়ে এ সরকার তার সব অপকর্ম জায়েজ করতে চায়। বিচারপতি খায়রুল হক প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের টাকা নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিলের রায় দিয়েছেন। বর্তমানে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক কত টাকা নিয়ে রায় দিচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষ জানতে চায়। বিচারকের চেয়ারে বসে উনি যে সব মন্তব্য করেন তা শুনলে মনে হয় উনি একজন বিকারগ্রস্ত পাগল। কোনো পাগল দিয়ে তো আদালত চলতে পারে না মাননীয় স্পিকার। মাননীয় স্পিকার, আইনজীবীরা বলেন, উনাকে নাকি মাঝে মাঝে ভূতে ধরে। ওই আদালতে বসে উনি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কী কী অপকর্ম করেন তা আমরা জানি। আমি আইনমন্ত্রীকে আহ্বান জানাচ্ছি এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য। মাননীয় স্পিকার, শেখ মুজিব রক্ষীবাহিনী দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের হত্যা করেছিল। আর তার কন্যা ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের গায়ে পুলিশের পোশাক পরিয়ে পুলিশ লীগ দিয়ে আজ বিএনপি নেতাদের হত্যা করছে। লক্ষ্মীপুরে রুবেল, কাশেমকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা বলতে চাই, রুবেল-কাশেমকে হত্যা করে আপনি বিএনপিকে ধ্বংস করতে পারবেন না। কারণ এক রুবেলের রক্ত থেকে বিএনপিতে লাখ লাখ রুবেল জন্ম নেবে মাননীয় স্পিকার।
মাননীয় স্পিকার, একের পর এক লাশ পড়ছে, আর আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লজ্জের মতো বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক আছে। টেলিভিশনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভেটকি হাসি দেখলে মানুষ ভয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়। উনি বললেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের গ্রেফতার করবেন। ৪৮ ঘণ্টা কবে শেষ হবে মাননীয় স্পিকার? পুলিশ বিএনপি নেতাদের গ্রেফতার করতে পারে, বিএনপির এমপিদের পেটাতে পারে। কিন্তু সাগর রুনির হত্যাকারীদের ধরতে পারে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী নিজে সাগর-রুনির হত্যাকারীদের আঁচলের তলে আশ্রয় দিয়েছেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসীদের লালন করেন, খুনিদের লালন করেন। তিনি সন্ত্রাসীদের গডফাদার। মাননীয় স্পিকার, আমাদের প্রিয় নেতা তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার আমাদের প্রিয় নেতা। তারেক রহমানের নাম শুনলেই উনাদের গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যায়। উনারা মৃগি রোগীর মতো খিচুনি দিয়ে ওঠেন। মাননীয় স্পিকার, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তার বিরুদ্ধে সরকার ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের করেছে। (সরকারি দলের সদস্যদের হৈহৈ ও চিত্কার )
মাননীয় স্পিকার, বিএনপির নেতৃত্বের ক্ষেত্রে শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার পর কে—প্রশ্ন করা হলে সবাই এক বাক্যে বলবেন—তারেক রহমান। কিন্তু আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনার পর কে প্রশ্ন করা হলে উত্তর দেয়া সম্ভব নয় বলেই তারেক রহমানের ব্যাপারে সরকারের এত গাত্রদাহ। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট অর্থ পাচার মামলায় ভুয়া অভিযোগ প্রমাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডেবরা না থেবরা নামের এক বুড়ি সাদা চামড়ার শয়তান মহিলা ভাড়া করে আনা হয়েছে। (এ সময় স্পিকার বলেন, শয়তান ও বুড়ি শব্দ দু’টি এক্সপাঞ্জ করা হলো।) মাননীয় স্পিকার, সরকারের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ আজ স্লোগান দিচ্ছে চশমা পরা বুবুজান, নৌকা লইয়া ভারত যান। অথচ প্রধানমন্ত্রী আমাদের নেত্রীকে পাকিস্তান যেতে বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক আমলে দুই নেত্রীকে বিদেশ পাঠাতে চাইলে শেখ হাসিনা চলে গিয়েছিলেন। অথচ আমাদের নেত্রী বলেছেন—এ দেশ আমার ঠিকানা, বিদেশে আমার কেউ নেই। আমি এদেশ ছেড়ে যাব না।
মাননীয় স্পিকার, ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা আইএসআইর কাছে থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার নিয়েছিলেন। এ নিয়ে তখন ভারত অসন্তুষ্টও হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উনি মইন ইউ আহমদের কোলে বসেছেন। শুধু মইন নয়, আরও কোথায় কোথায় বসেছেন এদেশের মানুষ জানে। উনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় মদ পান করে মাতলামি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। জয় এখন আমেরিকায় কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা করছে। তার বাবাতো ব্যবসায়ী ছিলেন না। কোথায় পেয়েছে এত টাকা তার বিচার একদিন হবে। মাননীয় স্পিকার, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মানুষ বলে-তার জন্মের সময় মুখে মধু দেয়া হয়নি। একটি গান আছে তুতু তু তুতু তারা-মর্জিনার মা মার্কা মারা। এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বলছে-তুতু তু তুতু তারা, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখ মার্কা মারা। মাননীয় স্পিকার, ভারতীয় বিএসএফ আমার ভাইকে লুঙ্গি খুলে পেটানোর পরও এক মন্ত্রী বলেন সবকিছু ঠিক আছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই-যেভাবে ভারতের দালালি করছেন কিছু দিন পর ভারতীয় মহিলা পুলিশ আপনাকে এবং আইন প্রতিমন্ত্রীকে লুঙ্গি খুলে পেটালে কী বলবেন। আইন প্রতিমন্ত্রী কথা বললে মুখ থেকে নর্দমার গন্ধ বের হয়। জনরোষে মুখে এসব মন্ত্রী কাপড় ছাড়াই দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হবে। মাননীয় স্পিকার, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চাচ্ছেন তারা। এটা দিবাস্বপ্ন। এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না। আর বিএনপি ছাড়া কোনো নির্বাচন এদেশের মানুষ হতে দেবে না। যতই আমাদের নির্যাতন করেন, আমরা ভয় পাই না। আমরা শহীদ জিয়ার সূর্যসৈনিক। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রই আমরা সফল হতে দেব না। দাদা বাবু, কাকা বাবুদের দিয়ে এদেশকে নতজানু করে রাখতে পারবে না। রানুর বক্তব্য চলাকালেই মাইক বন্ধ হয়ে যায়। স্পিকার বলেন, মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যে অসংসদীয় কিছু থাকলে তা এক্সপাঞ্জ করা হবে। পরে স্পিকার মাগরিবের নামাজের বিরতি ঘোষণা করলে উত্তাপ থামে।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates