লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খেলার কৌশল শিখাচ্ছেন দিলীপ চক্রবর্তী
ছবি: প্রথম আলো
সত্যি
গল্পটা এমন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে খেললেন এবং
পরাজিত হলেন। পরে তিনি আবার বিদ্যালয়ে এলেন। তবে শিক্ষক হিসেবে। কঠোর
পরিশ্রম করে বিজয়ী করলেন শিক্ষার্থীদের। গর্বে বুক ভরালেন সবার।
এই শিক্ষকের নাম দিলীপ চক্রবর্তী (৫১)। আর বিদ্যালয়টি হলো নড়াইল জেলার লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সমিতির আয়োজনে শীতকালীন অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ২০০৮ সাল থেকে দেশসেরা হচ্ছে বিদ্যালয়টি। শুধু অ্যাথলেটিকস নয়; ফুটবল, হকিসহ অন্যান্য খেলায়ও সফল হচ্ছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা, সংস্কৃতিতেও এগিয়ে রয়েছে বিদ্যালয়টি।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের ক্রীড়া কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদউদ্দৌলা প্রথম আলোকে জানান, অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় যশোর শিক্ষা বোর্ড পাঁচ বছর ধরে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। এই কৃতিত্বের দাবিদার লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তী।
যেভাবে শুরু: দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে শীতকালীন অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ। তখন ব্যর্থ হলেও তিনি খেলার মাঠ ছাড়েননি। লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের মাঠে বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের সঙ্গে নিয়মিত খেলেছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের খেলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ২০০২ সালের কথা। লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক শক্তিপদ সরকার তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য দিলীপকে অনুরোধ করেন। রাজি হয়ে যান দিলীপ। শুরু করেন নিবিড় প্রশিক্ষণ। ওই বছরই জাতীয় শীতকালীন অ্যাথলেটিকসে স্বর্ণপদক পায় বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে স্বর্ণপদক আসে চারটি। পরের বছর দিলীপকে খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৪ সালে চারটি ও ২০০৫ সালে পাঁচটি স্বর্ণপদক পায় বিদ্যালয়টি। এরপর প্রতিবছর পদকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বিদ্যালয়ে এক দিন: লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় জেলার লোহাগড়া উপজেলার নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত। দুই একর জায়গা নিয়ে ১৯০২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটিতে এক হাজার ৭২৫ জন শিক্ষার্থী ও ৪৫ জন শিক্ষক আছেন। সম্প্রতি এক দিন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় চত্বর ও খেলার মাঠে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে খেলাধুলার চর্চা করছে। সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি জানান, এ বছর ৩০ জন ছাত্রী ও ২২ জন ছাত্র নিয়মিত চর্চা করছে। বেলা চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত এ চর্চা হয়। জাতীয় পর্যায়ে এ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাই বেশি কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। আশপাশের বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীও এদের সঙ্গে চর্চা করে। তারাও জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। ‘আমি অপেক্ষায় আছি, আমার ছেলেমেয়েরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।’ বলছিলেন দিলীপ।
সাফল্যগাথা: দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলার সর্ববৃহৎ আসর অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ছাত্র ও ছাত্রী বিভাগে মোট ৩৪টি ইভেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে এ বছর ২৬টি পদক পেয়েছে লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এর মধ্যে স্বর্ণপদক ১৪টি ও রৌপ্যপদক আটটি। বাকিগুলো ব্রোঞ্জপদক। ২০১১ সালে পায় ৩৪টি পদক। এর ১৭টি ছিল স্বর্ণ। ২০১০ সালে পেয়েছিল ২৫টি পদক, যার ১৩টি স্বর্ণ। সর্বোচ্চ ৩৯টি পদক আসে ২০০৯ সালে। এর ১৯টি ছিল স্বর্ণ। এর আগে ২০০৮ সালে ১৪টি, ২০০৭ সালে সাতটি, ২০০৬ সালে ১৬টি পদক পায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১,৫০০ মিটার দৌড়, রিলে দৌড়, দীর্ঘ ও উচ্চ লাফ এবং গোলক, বর্শা, চাকতি নিক্ষেপসহ প্রায় সব বিভাগে কৃতিত্ব অর্জন করেছে তারা।
তা ছাড়া এ বছর জাতীয় মহিলা হকি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নড়াইল জেলা দল। দলের ১৪ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজন ছিল লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী। এ বছর জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক পেয়েছে নড়াইল জেলা দল। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মধ্যে ১৮ জনই ছিল লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পদ্মাবতী সমাদ্দার অনূর্ধ্ব ১৭ বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। বিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ পেয়ে বিজেএমসির খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় প্রতিযোগিতা করছে। এ বিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রী উভয় বিভাগে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, হকি ও হ্যান্ডবল দল আছে। এসব দলের সদস্যরা প্রায়ই জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে থাকে।
এ সাফল্যের কারণ জানতে চাইলে দিলীপ বলেন, ‘নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করলেই সফল হওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা নিয়ে এ বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছি। এটা আমার পেশা নয়, নেশা। আমার পরিবার ত্যাগ স্বীকার না করলে এতে ভালো করা সম্ভব হতো না।’
স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে দিলীপের সংসার। স্ত্রী রানী বালা মজুমদার লোহাগড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা।
কৃতীরা যা বলে: বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পদ্মাবতী সমাদ্দার এ পর্যন্ত নয়টি স্বর্ণপদক পেয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। সে বলে, ‘লক্ষ্য ছিল, জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যেকটি ইভেন্টে প্রথম হব। সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে চর্চা করেছি। সফলও হয়েছি।’ তার মা মমতা রানী সমাদ্দার বলেন, ‘আমরা কৃষক পরিবার। কোনো রকম দিন চলে। তিন মেয়ের মধ্যে এই ছোট মেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। এত অর্জন সম্ভব হচ্ছে দিলীপ স্যারের জন্য।’
জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্ব অর্জনকারী সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম বলে, ‘দিলীপ স্যারের সঙ্গে প্রতিদিন বিকেলে অনুশীলন করি। আর প্রতিদিনই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি।’
কর্মকর্তারা যা বলেন: নড়াইল জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা খান মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘দিলীপ বাবু নিজে জাতীয় পর্যায়ের কোনো খেলোয়াড় নন। অথচ তিনি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের এ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। এর পেছনে তাঁর নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে।’
লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় কুমার দাস বলেন, ‘সফল এ শিক্ষার্থীদের পরিবারে অসচ্ছলতা আছে। বিদ্যালয়ে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব রয়েছে। তার পরও দিলীপ চক্রবর্তীর নিবিড় প্রশিক্ষণের ফলে ধারাবাহিক বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।’
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও নড়াইল-২ আসনের সাংসদ এস কে আবু বাকের বলেন, ‘স্কুলপর্যায়ে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ বিদ্যালয়ের ধারাবাহিক সাফল্য বিস্ময়কর। এটা সম্ভব হচ্ছে দিলীপ বাবুর বিশেষ প্রচেষ্টায়।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক টি এম জাকির হোসেন বলেন, ‘লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের জন্য পাঁচ বছর ধরে অ্যাথলেটিকসে খুলনা বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। অ্যাথলেটিকসে ছেলেমেয়েরা উঠে আসুক, এ জন্য ওই বিদ্যালয়ের প্রতি বিশেষ খেয়ালও রাখি।’
পড়াশোনায়ও এগিয়ে: শুধু খেলাধুলায় নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও এ বিদ্যালয় কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ জন। ২০১১ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৮২ জন। পাসের হার ছিল ৯৮ ভাগ।
লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে আছে উন্মুক্ত মঞ্চ। এই মঞ্চ ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক বলয়। লোহাগড়ার উল্লেখযোগ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানেই হয়। বিদ্যালয়ে আছে সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, বিতর্ক ও নাটকের দল। তারাও আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। গত বছর এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দল ব্র্যাক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দেশসেরা হয়েছে।
এই শিক্ষকের নাম দিলীপ চক্রবর্তী (৫১)। আর বিদ্যালয়টি হলো নড়াইল জেলার লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া সমিতির আয়োজনে শীতকালীন অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ২০০৮ সাল থেকে দেশসেরা হচ্ছে বিদ্যালয়টি। শুধু অ্যাথলেটিকস নয়; ফুটবল, হকিসহ অন্যান্য খেলায়ও সফল হচ্ছে বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা, সংস্কৃতিতেও এগিয়ে রয়েছে বিদ্যালয়টি।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের ক্রীড়া কর্মকর্তা আ ফ ম আসাদউদ্দৌলা প্রথম আলোকে জানান, অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় যশোর শিক্ষা বোর্ড পাঁচ বছর ধরে শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। এই কৃতিত্বের দাবিদার লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় এবং বিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তী।
যেভাবে শুরু: দিলীপ চক্রবর্তী ১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালে শীতকালীন অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেন। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। তখন তিনি উপলব্ধি করলেন, এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে দরকার যথাযথ প্রশিক্ষণ। তখন ব্যর্থ হলেও তিনি খেলার মাঠ ছাড়েননি। লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের মাঠে বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের সঙ্গে নিয়মিত খেলেছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের খেলায় প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন। ২০০২ সালের কথা। লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক শক্তিপদ সরকার তাঁর বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য দিলীপকে অনুরোধ করেন। রাজি হয়ে যান দিলীপ। শুরু করেন নিবিড় প্রশিক্ষণ। ওই বছরই জাতীয় শীতকালীন অ্যাথলেটিকসে স্বর্ণপদক পায় বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী। ২০০৩ সালে স্বর্ণপদক আসে চারটি। পরের বছর দিলীপকে খণ্ডকালীন ক্রীড়া শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০০৪ সালে চারটি ও ২০০৫ সালে পাঁচটি স্বর্ণপদক পায় বিদ্যালয়টি। এরপর প্রতিবছর পদকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বিদ্যালয়ে এক দিন: লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় জেলার লোহাগড়া উপজেলার নবগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত। দুই একর জায়গা নিয়ে ১৯০২ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটিতে এক হাজার ৭২৫ জন শিক্ষার্থী ও ৪৫ জন শিক্ষক আছেন। সম্প্রতি এক দিন ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় চত্বর ও খেলার মাঠে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে খেলাধুলার চর্চা করছে। সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন দিলীপ চক্রবর্তী। তিনি জানান, এ বছর ৩০ জন ছাত্রী ও ২২ জন ছাত্র নিয়মিত চর্চা করছে। বেলা চারটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত এ চর্চা হয়। জাতীয় পর্যায়ে এ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাই বেশি কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। আশপাশের বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীও এদের সঙ্গে চর্চা করে। তারাও জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। ‘আমি অপেক্ষায় আছি, আমার ছেলেমেয়েরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে।’ বলছিলেন দিলীপ।
সাফল্যগাথা: দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে খেলাধুলার সর্ববৃহৎ আসর অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ছাত্র ও ছাত্রী বিভাগে মোট ৩৪টি ইভেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে এ বছর ২৬টি পদক পেয়েছে লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। এর মধ্যে স্বর্ণপদক ১৪টি ও রৌপ্যপদক আটটি। বাকিগুলো ব্রোঞ্জপদক। ২০১১ সালে পায় ৩৪টি পদক। এর ১৭টি ছিল স্বর্ণ। ২০১০ সালে পেয়েছিল ২৫টি পদক, যার ১৩টি স্বর্ণ। সর্বোচ্চ ৩৯টি পদক আসে ২০০৯ সালে। এর ১৯টি ছিল স্বর্ণ। এর আগে ২০০৮ সালে ১৪টি, ২০০৭ সালে সাতটি, ২০০৬ সালে ১৬টি পদক পায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০০, ২০০, ৪০০ ও ১,৫০০ মিটার দৌড়, রিলে দৌড়, দীর্ঘ ও উচ্চ লাফ এবং গোলক, বর্শা, চাকতি নিক্ষেপসহ প্রায় সব বিভাগে কৃতিত্ব অর্জন করেছে তারা।
তা ছাড়া এ বছর জাতীয় মহিলা হকি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নড়াইল জেলা দল। দলের ১৪ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে পাঁচজন ছিল লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী। এ বছর জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক পেয়েছে নড়াইল জেলা দল। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড়দের মধ্যে ১৮ জনই ছিল লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পদ্মাবতী সমাদ্দার অনূর্ধ্ব ১৭ বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়। বিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষার্থী ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) নিয়োগ পেয়ে বিজেএমসির খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় প্রতিযোগিতা করছে। এ বিদ্যালয়ে ছাত্র ও ছাত্রী উভয় বিভাগে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, হকি ও হ্যান্ডবল দল আছে। এসব দলের সদস্যরা প্রায়ই জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে থাকে।
এ সাফল্যের কারণ জানতে চাইলে দিলীপ বলেন, ‘নিয়মিত মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করলেই সফল হওয়া সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা নিয়ে এ বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আছি। এটা আমার পেশা নয়, নেশা। আমার পরিবার ত্যাগ স্বীকার না করলে এতে ভালো করা সম্ভব হতো না।’
স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে দিলীপের সংসার। স্ত্রী রানী বালা মজুমদার লোহাগড়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা।
কৃতীরা যা বলে: বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী পদ্মাবতী সমাদ্দার এ পর্যন্ত নয়টি স্বর্ণপদক পেয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। সে বলে, ‘লক্ষ্য ছিল, জাতীয় পর্যায়ে প্রত্যেকটি ইভেন্টে প্রথম হব। সেই অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে চর্চা করেছি। সফলও হয়েছি।’ তার মা মমতা রানী সমাদ্দার বলেন, ‘আমরা কৃষক পরিবার। কোনো রকম দিন চলে। তিন মেয়ের মধ্যে এই ছোট মেয়ে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করছে। এত অর্জন সম্ভব হচ্ছে দিলীপ স্যারের জন্য।’
জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্ব অর্জনকারী সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম বলে, ‘দিলীপ স্যারের সঙ্গে প্রতিদিন বিকেলে অনুশীলন করি। আর প্রতিদিনই নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি।’
কর্মকর্তারা যা বলেন: নড়াইল জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা খান মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘দিলীপ বাবু নিজে জাতীয় পর্যায়ের কোনো খেলোয়াড় নন। অথচ তিনি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের এ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। এর পেছনে তাঁর নিঃস্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে।’
লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় কুমার দাস বলেন, ‘সফল এ শিক্ষার্থীদের পরিবারে অসচ্ছলতা আছে। বিদ্যালয়ে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব রয়েছে। তার পরও দিলীপ চক্রবর্তীর নিবিড় প্রশিক্ষণের ফলে ধারাবাহিক বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।’
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও নড়াইল-২ আসনের সাংসদ এস কে আবু বাকের বলেন, ‘স্কুলপর্যায়ে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ বিদ্যালয়ের ধারাবাহিক সাফল্য বিস্ময়কর। এটা সম্ভব হচ্ছে দিলীপ বাবুর বিশেষ প্রচেষ্টায়।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় উপপরিচালক টি এম জাকির হোসেন বলেন, ‘লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের জন্য পাঁচ বছর ধরে অ্যাথলেটিকসে খুলনা বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। অ্যাথলেটিকসে ছেলেমেয়েরা উঠে আসুক, এ জন্য ওই বিদ্যালয়ের প্রতি বিশেষ খেয়ালও রাখি।’
পড়াশোনায়ও এগিয়ে: শুধু খেলাধুলায় নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতিতেও এ বিদ্যালয় কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ জন। ২০১১ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৮২ জন। পাসের হার ছিল ৯৮ ভাগ।
লোহাগড়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে আছে উন্মুক্ত মঞ্চ। এই মঞ্চ ঘিরে তৈরি হয়েছে একটি সাংস্কৃতিক বলয়। লোহাগড়ার উল্লেখযোগ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখানেই হয়। বিদ্যালয়ে আছে সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, বিতর্ক ও নাটকের দল। তারাও আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। গত বছর এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক দল ব্র্যাক বিতর্ক প্রতিযোগিতায় দেশসেরা হয়েছে।