0 জিএমজির শেয়ারবাণিজ্য, দুই দিনে তিন কোম্পানি

বেসরকারি খাতের জিএমজি এয়ারলাইনসের প্লেসমেন্ট (মূলধন সংগ্রহে আগাম বরাদ্দ) শেয়ার নিতে আড়াই মাসে নতুন পাঁচটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে গঠন করা হয় তিনটি কোম্পানি।
অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে নতুন কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে প্লেসমেন্টের শেয়ার ভাগবাঁটোয়ারা করা হলেও শেষ পর্যন্ত সুফল মেলেনি। তালিকাভুক্তির সব প্রক্রিয়া গুছিয়ে আনার পরও সবকিছুই ভেস্তে যায়। কারণ, তার আগেই শেয়ারবাজারে ধস নামে। এ সময় জিএমজির আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে নির্ধারিত দর নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দেয়। এ অবস্থায় সাময়িকভাবে কোম্পানিটির তালিকাভুক্তি আটকে যায়। তবে এখন আবার নতুন কৌশলে কোম্পানিটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
২০১০ সালের ১২ মে। শেয়ারবাজারের আলোচিত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সোমা আলম রহমান মিলে গঠন করেন নতুন কোম্পানি শোর ক্যাপ হোল্ডিংস লিমিটেড। এর প্রায় এক মাস পর ২০১০ সালের ১৪ জুন শোর ক্যাপকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় অ্যাডভেন্ট ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট নামের নতুন আরেকটি কোম্পানি। শোর ক্যাপের সঙ্গে মালিকানায় যুক্ত হন আহসান ইমাম, যিনি সম্পর্কে মোহাম্মদ লুৎফর রহমানের স্ত্রীর বড় ভাই।
অ্যাডভেন্ট ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট নামের কোম্পানি গঠনের পরদিন, ২০১০ সালের ১৫ জুন গঠিত হয় নতুন আরও দুটি কোম্পানি। এর একটি অ্যাবস্যুলিউট রিটার্ন লিমিটেড ও অন্যটি ইনোভেটিভ ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড। এই দুটিরও মালিকানার সঙ্গে যুক্ত লুৎফর রহমানের মালিকানাধীন শোর ক্যাপ হোল্ডিংস।
১৫ জুনের পর একই বছরের ২০ জুলাই গঠন করা হয় ইক্যুইটি গ্রোথ নামের নতুন আরও একটি কোম্পানি। এটির মালিকানায় যথারীতি লুৎফর রহমানের শোর ক্যাপ এবং মাহজাবিন মোস্তফা ইমাম। মাহজাবিন মোস্তফা ইমাম আহসান ইমামের স্ত্রী। জানা গেছে, প্লেসমেন্ট-বাণিজ্যের জন্যই লুৎফর রহমান একের পর এক নতুন কোম্পানি গঠন করেন।
যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের পরিদপ্তর বা রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজের (আরজেএসসি) থেকে সংগ্রহীত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূলত লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির ওপর কেন্দ্র করেই পরে স্বল্পতম সময়ে নতুন আরও চারটি কোম্পানি গঠন করা হয়, যার সঙ্গে আরও যুক্ত করা হয় লুৎফর রহমানের দুজন নিকটাত্মীয় ও একজন সহযোগীকে। কোম্পানি গঠনের পরপরই সেগুলোর নামে নেওয়া হয়েছে জিএমজি এয়ারের বিপুলসংখ্যক প্লেসমেন্ট শেয়ার।
লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সোমা আলম রহমান, আহসান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী মাহজাবিন ইমামের নাম উল্লেখ রয়েছে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে উল্লিখিত ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে আরেক আলোচিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের। তাঁর সঙ্গে লুৎফর রহমানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ রয়েছে জিএমজি শেয়ারের প্লেসমেন্ট-বাণিজ্যের নানা তথ্য-উপাত্তে। জিএমজি এয়ারলাইনসের প্লেসমেন্ট-বাণিজ্যের সঙ্গে আরও যুক্ত রয়েছেন আরেক আলোচিত ব্যবসায়ী নূর আলী।
যাঁর নামে যত প্লেসমেন্ট: পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে প্লেসমেন্ট-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, কোম্পানি প্লেসমেন্টে প্রায় ছয় কোটি শেয়ার ছেড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। প্লেসমেন্টে প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৫০ টাকা।
এর মধ্যে লুৎফর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সোমা আলম রহমানের মালিকানাধীন নিউ ইংল্যান্ড ইক্যুইটির নামে রয়েছে ১৫ কোটি টাকা সমমূল্যের ৩০ লাখ শেয়ার, শোর ক্যাপ হোল্ডিংসের নামে রয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা সমমূল্যের প্রায় ৬৪ লাখ শেয়ার, লুৎফর রহমানের নিজের নামে রয়েছে ৫০ লাখ টাকা সমমূল্যের এক লাখ শেয়ার।
এ ছাড়া অ্যাবস্যুলিউট রিটার্ন ও ইক্যুইটি গ্রোথ লিমিটেডের প্রায় ৩২ কোটি টাকা করে ৬৪ কোটি টাকার প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ শেয়ার, অ্যাডভেন্ট ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্টের নামে রয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা সমমূল্যের প্রায় ৬৪ লাখ শেয়ার, ইনোভেটিভ ক্যাপিটালের নামে রয়েছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৩৪ লাখ শেয়ার। সব মিলিয়ে লুৎফর রহমান ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নামেই রয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখেরও বেশি শেয়ার, যা প্লেসমেন্টে ইস্যু করা মোট শেয়ারের অর্ধেকেরও বেশি। এর বাইরে নূর আলীর একক নামে রয়েছে সাড়ে ১৬ কোটি টাকার ৩৩ লাখ শেয়ার। নূর আলীর মালিকানাধীন কোম্পানি বোরাক ট্র্যাভেলসের নামে রয়েছে চার কোটি টাকার আট লাখ শেয়ার, ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেডের নামে আছে সাড়ে চার কোটি টাকার আরও নয় লাখ শেয়ার।
এ ছাড়া শরীকুল্লাহ ও আশিকুল্লাহর (পিতা-পুত্র) মালিকানাধীন অ্যাপোলো ট্রেডিংয়ের নামে রয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকার ৬৪ লাখের বেশি শেয়ার। এর বাইরে বেশ কয়েকজন বিদেশি ও দেশি সাধারণ বিনিয়োগকারীর নামে কোম্পানিটির প্রায় ৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা সমমূল্যের এক কোটি ৬৪ লাখেরও বেশি শেয়ার রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালে উল্লিখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জিএমজির প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির পর শুরু হয় কোম্পানিটিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ। তালিকাভুক্তির জন্য বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে জিএমজির প্রতিটি শেয়ারের দাম নির্ধারিত হয় ১৫০ টাকা। অর্থাৎ, প্লেসমেন্টে বরাদ্দ করা শেয়ারের চেয়ে বাজারদর ছিল ১০০ টাকা বেশি। সবকিছু গুছিয়ে আনার পরও শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটি আর বাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। ফলে আর্থিক সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। এর ফলে চলতি বছরের মার্চে এয়ারলাইনসটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কবে সেটি চালু করা হবে, তা-ও নিশ্চিত নয়। সেখানে চলছে কর্মী ছাঁটাই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নতুন করে জিএমজি এয়ারলাইনসকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া চলছে। সেই সঙ্গে চলছে কোম্পানিটির প্লেসমেন্ট শেয়ারে আটকে থাকা অর্থ পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, নতুন করে এয়ারলাইনসটির নাম পরিবর্তন করে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন কোম্পানিটির সিংহভাগ মালিকানায় থাকা বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো লিমিটেডের সঙ্গে একে একীভূত করারও চেষ্টা চলছে। সে ক্ষেত্রে নাম পরিবর্তন করে বেক্সিমকো এয়ার করারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়।
সালমানের যোগসূত্র: অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল এয়ারলাইনসটি। এ সময়ই সালমান এফ রহমান কোম্পানিটির বেশির ভাগ শেয়ার কিনে নেন। শেয়ারবাজারে চাঙাভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেন। লোগো পরিবর্তন করে রুট বাড়িয়ে একে নবরূপ দেওয়া হয়। তার পরই শুরু হয় প্লেসমেন্ট-বাণিজ্য।
জিএমজিকে ঘিরে এসব ঘটনার বিষয়ে জানতে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জিএমজির বিষয়ে যেকোনো ধরনের কথা বলার জন্য তিনি এয়ারলাইনসটির এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেন।
পরে জিএমজির কর্মকর্তা আসিফ আহমেদের কাছে ই-মেইলে গত বৃহস্পতিবার বেশ কিছু বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু গতকাল সোমবার পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া এসব বিষয়ে লুৎফর রহমান ও জিএমজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাব সাত্তারের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাঁরা দুজনই বেশ কিছুদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করায় শেষ পর্যন্ত তাঁদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
 

BANGLADESHI UPDATE NEWS Copyright © 2011 - |- Template created by O Pregador - |- Powered by Blogger Templates